খেলা

একান্ত সাক্ষাৎকার- খালেদ মাহমুদ সুজন

এখনো ক্রিকেটের অনেক অন্তরায়

২৪ মার্চ ২০১৮, শনিবার, ৯:৪৪ পূর্বাহ্ন

১৯৭৬, বয়স তখন পাঁচ, ভাইয়ের সঙ্গে মাঠে যাওয়া। ক্রিকেট খেলা অনেকের কাছে তখন শুধুই শখের বিষয়। মাঠে বল কুড়াতে কুড়াতে, ভাইয়ের খেলা দেখেই ক্রিকেটে হাতেখড়ি খালেদ মাহমুদ সুজনের। এরপর কেটে গেছে ৪০ বছর। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেটে জায়গা করে নিয়েছেন। শত আলোচনা-সমালোচনার মাঝেও তিনি মাঠের ঘাস আঁকড়ে এগিয়ে যাচ্ছেন স্বপ্ন নিয়ে। আকরাম খান, আমিনুল ইসলাম বুলবুলদের মতো না হলেও বাংলাদেশ ক্রিকেটের অগ্রযাত্রায় তাকে আড়ালের নায়ক বললেও ভুল হবে না। বারবার কঠিন সময়ের চ্যালেঞ্জ নিয়ে দাঁড়িয়েছেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের পাশে। বার্ধক্য গ্রাস না করা পর্যন্ত থাকতে চান মাঠেরই একজন হয়ে। নিজের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে অকপটে কথা বলেছেন দৈনিক মানবজমিনের স্পোর্টস রিপোর্টার ইশতিয়াক পারভেজের সঙ্গে সেই কথোপকথনের মূল অংশ তুলে ধরা হলো-
প্রশ্ন: আপনার ক্রিকেটে আসার গল্পটা যদি বলতেন?
মাহমুদ: তখন বয়স কত হবে? পাঁচ কিংবা ছয়। ভাইয়া ক্রিকেট খেলতেন, তার সঙ্গেই ধানমন্ডির ঈদগাঁ মাঠে সূর্যতরুণের অনুশীলনে যেতাম। কাজ ছিল বল কুড়ানো আর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাইয়ের খেলা দেখা। এরপর সেখান থেকে চলে এলাম আমরা সিদ্ধেশ্বরীতে। তখন সেখানে একটি পাড়ার লীগ হতো। আমি সেই লীগে খেলতে আমার ভাই, ভাতিজা ও বন্ধুদের নিয়ে একটি দল বানিয়ে ফেললাম। সেখানে দারুণ খেলার সুবাদে আমাকে তখনকার অন্যতম সেরা দল অমরজ্যোতি ক্লাব থেকে খেলতে বলা হলো। আমি কিন্তু তখন লেগ স্পিন করতাম। কিন্তু পরে এক বড় ভাইয়ের কথাতে মিডিয়াম পেস শুরু করি। আমার প্রথম ম্যাচে মিডিয়াম পেসে ১৩ রানে চার উইকেট পাই সিটি ক্লাব মাঠে। এরপরের বছর থেকে আমি ওপেনার ব্যাটসম্যান হিসেবেও খেলা শুরু করি। তখন থেকেই বেশ সাহস ছিল। কাউকে ভয় পেতাম না। বড় বড় ক্রিকেটারদের বলে ছক্কা মেরে দিতাম। এরপর ধীরে ধীরে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলে সুযোগ পেলাম। অধিনায়ক হলাম ১৯৮৯ এ। ইংল্যান্ডে গেলাম, এছাড়াও এশিয়া কাপ খেললাম। তারপর তো মোহামেডানে। সেখানে খেলতে খেলতে জাতীয় দলে সুযোগ। এখনো আছি ক্রিকেটের সঙ্গেই।
প্রশ্ন: সেই সময়ের সঙ্গে এখনকার পার্থক্য কী?
মাহমুদ: আমাদের সময়ে ছিল পাড়ার মাঠ, পাকা উইকেট। এমন জিম ছিল না, এমন মাঠ ও উইকেট ছিল না। এখনকার ক্রিকেটাররা শুরু করে কোনো না কোনো কোচের অধীনে। জিমে যায়, দারুণ সব মাঠে অনুশীলন করে। পার্থক্যটা হচ্ছে সুযোগ সুবিধায়। আমাদের সময় তো টাকাও ছিল না। এখনতো ক্রিকেট মানেই অনেক টাকার বিষয়। আমাদের ক্লাবে তো নাস্তা করারও টাকা ছিল না। আম্মার কাছ থেকে ৩০০ টাকা এনে নাস্তা করতাম। আমার বাবা-মা কত যে ৩’শ টাকা দিয়েছে তার হিসাব নেই। তাদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ আমি। একবার মনে আছে ক্লাবে খেলে ৪ হাজার টাকা পেয়েছিলাম। কিন্তু সেটিও আমি নেইনি। কারণ আমরা তখন দ্বিতীয় বিভাগ থেকে প্রথম বিভাগে উঠি। সবার কথা ছিল যে আমরা যে দলে খেলেছি সেখানেই খেলবো। কিন্তু আমাদের এক ভাই সৌমিত্র সাহা তিনি অন্য দল থেকে ১০ হাজার টাকার প্রস্তাব পেয়েছিলেন। তখন তাকে আমরা রেখে দিতে তিনজন মিলে নিজেদের টাকাটা দিয়ে দেই। আরো মজার ঘটনা হলো প্রথম যেবার একটি ম্যাচ খেলার পর আমার হাতে ৫’শ টাকা দিলো তখন আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম। কারণ আমি তখনো জানতাম না যে ক্রিকেট খেলে টাকা পাওয়া যায়?
প্রশ্ন: টাকার প্রয়োজন ও এর প্রভাব কিভাবে দেখেন?
মাহমুদ: বেশি প্রভাব অবশ্যই ক্ষতিকর। কারণ একজন ক্রিকেটারের কখনো টাকার পেছনে ছোটা উচিত নয়। টাকা তাদের পেছনে ছুটবে। এর অনেক বড় প্রমাণ কিন্তু সাকিব, তামিম, মুশফিকরা। ওরা নিজেদের এমন জায়গাতে নিয়ে গেছে যেখানে টাকাই এখন ওদের পেছনে ছুটছে। আমি বলবো, যারা এখন ক্রিকেটে আসবে তাদের আগেই টাকার কথা না ভেবে নিজের খেলার উন্নতি করতে হবে। অবশ্যই টাকার প্রয়োজন আছে কিন্তু ক্রিকেটের আগে সেটি যেন না আসে।
প্রশ্ন: আগের সঙ্গে বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতির পার্থক্য কোথায়?
মাহমুদ: আমার কথাই ধরেন, আমি যখন খেলতাম জাতীয় দলে একটি ম্যাচ খারাপ খেলেই বাদ পড়তাম। আমি অনেকবার বাদ পড়েছি। আমি ১৯৯৯ বিশ্বকাপে হিরো ছিলাম। কিন্তু এসেই দল থেকে বাদ পড়েছি। তখন যারা নির্বাচক ছিল, তাদের সম্মান করেই বলছি তারা কিন্তু সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। তারা যে কিভাবে চিন্তা করতেন জানি না। এমনও কথা বলতো যে, ও এটি কী খেলে আমি হলে তো এভাবে খেলতাম। এগুলো তখনকার নির্বাচকের অদ্ভুত সব খেয়াল ছিল। সেই কারণে আমরা এখন যারা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি তাদের মধ্যে চিন্তাটা ভিন্ন। অনেকেই প্রশ্ন করেন, কেন সৌম্যকে এত সুযোগ দেয়া হচ্ছে, সাব্বিরকে কেন এত খেলানো হচ্ছে। এগুলো আসলে ঠিক না। আমাদের উচিত একজন প্রতিভাবান ক্রিকেটারকে পর্যাপ্ত সুযোগ দেয়া। যদি সেটি দিতে না পারি সে নিজেকে কিভাবে প্রমাণ করবে?
প্রশ্ন: মাঠের কোনো স্মৃতি আপনাকে তাড়িয়ে বেড়ায়?
মাহমুদ: ৯৯’ এর বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে সেই জয় আমি কোনো দিনই ভুলতে পারবো না। সেটিই ছিল আমাদের প্রথম কোনো টেস্ট খেলুড়ে দেশের বিপক্ষে জয়। আর একটি হলো আমার নেতৃত্বেই পাকিস্তানের বিপক্ষে মুলতান টেস্টের হার। এই দুটি স্মৃতি আমার ক্রিকেট জীবনের কষ্ট ও অনুপ্রেরণা।
প্রশ্ন: আপনার অনেক দায়িত্ব পালন নিয়ে সমালোচনাকে কিভাবে দেখেন?
মাহমুদ: যখন কিছু বুঝতাম না তখন থেকেই ক্রিকেটের সঙ্গে আছি। এখনতো অনেক কিছু বুঝি জানি। আমি কিন্তু কারো কাছে কিছু চেয়ে নেইনি। আমি বোর্ড পরিচালক হয়েছি নির্বাচন করে। আর যেহেতু মাঠে ক্রিকেটার ছিলাম, এদেশের ক্রিকেটের কারণে আমি আজ সুজন। তাহলে কেন আমি এদেশের ক্রিকেটকে কিছু দেবো না? তাই কোচ হিসেবে ক্রিকেটার তৈরি করা। ক্রিকেটারদের পথ দেখানো আমার কাজ। আমিতো মাঠ ছাড়তে পারবো না। সত্যি কথা আমাকে ক্রিকেটের কোনো দায়িত্ব দিলে আমি না করতে পারি না। আমার সব কিছু ছাড়া সম্ভব, ক্রিকেট নয়। আমি মনে করি যতদিন শরীরে শক্তি আছে, বার্ধক্য গ্রাস না করছে ততোদিন আমি মাঠে আসবোই। এমনকি বুড়ো হয়ে গেলেও যতটুকু সম্ভব হয় মাঠে এসে খেলা দেখবো।
প্রশ্ন: প্রায়ই বোর্ড ও ক্রিকেটারদের দ্বন্দ্বের কথা শোনা যায়, তা কতটা সত্যি?
মাহমুদ: কাচের ভেতরে ও বাইরে থেকে কিন্তু খেলা দেখার অনেক পার্থক্য। মাঠে যে ছেলেগুলো খেলে তারা নিজেদের সেরাটাই দিতে মরিয়া থাকে। মাঠে প্রতিটি বলে বলে পরিস্থিতি পরিবর্তন হয়। এখানে সাকিব জানে কী করতে হয়, মাশরাফি জানেন কী করতে হয়। আবার বোর্ডও কিন্তু ওরা যেন সফল হয় এজন্য সব করে যাচ্ছে। এখন বাইরে থেকে কেউ যদি কোনো মন্তব্য করে তাহলে কী বলার আছে। আমরা অনেক আবেগপ্রবণ জাতি। কিন্তু এ আবেগ একটু নিয়ন্ত্রণও করা প্রয়োজন। এগুলো যেমন ক্রিকেটারদের কষ্ট দেয়, তেমনি বোর্ডেরও গতিরোধ করে। দেখেন ভারতের বিপক্ষে শেষ ওভারে কেন সৌম্যকে দেয়া হলো, কেন রুবেলকে বল করানো হলো এ নিয়েও কত সমালোচনা। কিন্তু এ রুবেলই কিন্তু প্রথম ৩ ওভারে ১৩ রান দিয়ে ম্যাচটা আমাদের হাতে এনেছিল। তাই বলবো কোনো মন্তব্য করার আগে ভাবা উচিত।
প্রশ্ন: কোচ হওয়াটা আপনার কাছে এত বড় কেন?
মাহমুদ: আজ আপনারা আমার সঙ্গে কথা বলছেন কারণ বাংলাদেশ ক্রিকেট আমাকে সেই জায়গাটি করে দিয়েছে। এখান থেকে আমি অনেক কিছুই পেয়েছি। তাই এখন সময় সেই ঋণগুলো শোধ করার। আমার অনেক বড় স্বপ্ন একদিন বাংলাদেশ দলের প্রধান কোচ হবো। এবার একটি অন্তর্বর্তীকালীন দায়িত্ব পেয়েছিলাম। একটি সিরিজেই কিন্তু দলকে এত তাড়াতাড়ি গোছানো সম্ভব নয়। হাথুরু বলেন, আর অন্য যারা সফল হয়েছে তারা কিন্তু দুই তিনটা সিরিজ সময় নিয়েই হয়েছে। আমি যদি সুযোগ পাই চেষ্টা করবো নিজেকে প্রমাণ করার।
প্রশ্ন: অনেক ক্রিকেটার আছেন যাদের বিদায় দিয়ে একটু সম্মান দেখানো হয়নি। এটি কিভাবে দেখেন?
মাহমুদ: অবশ্যই বিষয়টি বেশ কষ্টের। কারণ একজন ক্রিকেটার কিন্তু নিজের সবটুকু উজাড় করে দেশের জন্য খেলে। অবশ্য তাকে বোর্ডের পক্ষ থেকে সম্মানের সঙ্গে বিদায় দেয়া উচিত। আবার ক্রিকেটারের জন্য বিদায় বলা কঠিন হলেও সঠিক সময়ে সেটি বলে দিতে হয়। যেমন আমি ২০০৬, শ্রীলঙ্কা সফরে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নিয়েছিলাম। মাশরাফিও তাই করেছে। তবে আশা করি বোর্ড বিষয়টি নিয়ে ভাববে। যেন ক্রিকেটাররা সম্মান নিয়ে অবসর নিতে পারে।
প্রশ্ন: ক্রিকেটের অগ্রযাত্রায় সাবেক ক্রিকেটারদের ভূমিকা কতটা প্রয়োজন বলে মনে করেন?
মাহমুদ: দেখেন স্বাধীনতার আগে যারা ক্রিকেট শুরু করেছেন তাদের কিন্তু খেলার মতো কিছুই ছিল না। অনেককে বাসা থেকে টাকা এনে খেলতে হতো। বোর্ডেরও তো টাকা ছিল না, এমনকি ট্যুর করার জন্যও পাঠাতে কষ্ট হতো। কিন্তু এরপরও যারা খেলে গেছেন তাদের হাত ধরেই আমরা। এরপর এসেছে মাশরাফি, সাকিবরা। এভাবেই ধাপে ধাপে ক্রিকেটারদের হাত ধরেই কিন্তু এদেশের ক্রিকেট এগিয়ে যাচ্ছে। আমি তাই নতুন প্রজন্মের ক্রিকেটারদের বারবার বলি যে ঘাম-শ্রম ছাড়া ক্রিকেটকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। তারা যেন আরামে ক্রিকেট উপভোগ না করে নিজেদের ভূমিকাটা রাখার চেষ্টা করে।
প্রশ্ন: আপনি বলেছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের বড় অন্তরায় মিডিয়া। এটি ছাড়া কি অন্য কোনো অন্তরায় নেই?
মাহমুদ: অবশ্যই আছে। অনেক কিছুই এখনো বাংলাদেশে ক্রিকেটের এগিয়ে যাওয়ার পথে অন্তরায়। যেমন আমাদের আঞ্চলিক ক্রিকেটের কথাই বলেন। সেটি যদি না হয়, শুধু এখানে বড় বড় ক্লাবের ক্রিকেট খেললেই হবে না। আমাদের দেশের প্রতিটি জেলাতে ক্রিকেটের অবকাঠামোর উন্নতি করতে হবে। পাইপ লাইন যেন সঠিক থাকে তার জন্য নিয়মিত ‘এ’ দলের খেলা রাখতে হবে। এছাড়াও এইচপি ও অনূর্ধ্ব-১৯ দলের খেলার মান বাড়াতে হবে। আমি বলবো এখনো এই বিষয়গুলো জোরালো ভাবে হচ্ছে না। আমার মতে এদেশের ক্রিকেটে অনেক অন্তরায় আছে। সেগুলোকে ঠিক করাই হবে সামনের লক্ষ্য।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status