প্রথম পাতা

বাবার পর চলে গেলেন মা-ও, কী নিয়ে বাঁচবে তানজীদ

মহিউদ্দিন অদুল

২৪ মার্চ ২০১৮, শনিবার, ৯:৩৭ পূর্বাহ্ন

দাদা পাইলট ছিলেন। বাবাও। বাবার সঙ্গে বিমান চালানোর স্বপ্ন ছিল ষোল বছর বয়সের তানজীদ বিন সুলতানের। কিন্তু এই কিশোরের সেই স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেছে গত ১২ই মার্চ। নেপালের ত্রিভুবনে বিমান দুর্ঘটনায়। পরদিন মারা যান তার আহত পিতা পাইলট ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতান। পিতার শূন্যতা ভুলে স্বাভাবিক হতে চেয়েছিল সে। মাকে আঁকড়ে বাঁচতে চেয়েছিল। কিন্তু স্বামী আবিদের শোকে দু’বার ব্রেইন স্ট্রোক করেন তার মা। মায়ের সুস্থ হয়ে ফেরার প্রার্থনায় ছিল প্রত্যাশাও। তাই পিতৃবিয়োগের কষ্ট ভুলতে গতকাল মোটর শোতে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল তানজীদের। কিন্তু তা আর হয়ে উঠলো না। তার আগেই গতকাল সকাল সাড়ে ন’টার দিকে তাকে একা রেখে না ফেরার দেশে চলে গেছে তার মা আফসানা খানম টপি। পিতার পর মায়ের এমন বিয়োগে এতিম তানজীদ একেবারে পাথর হয়ে গেছে। হয়ে গেছে বাকরুদ্ধ। শুকিয়ে গেছে চোখের অশ্রু। এ অবস্থায় গতকাল তার হারানো শেষ অবলম্বন মা’কে বাবার পাশে বনানীর সামরিক কবরস্থানে সমাহিত করে এলো কিশোর তানজীদ। ৯ দিনের ব্যবধানে বাবা-মা হারিয়ে এতিম হয়ে যাওয়া তানজীদ এখন কী নিয়ে বাঁচবে- এমন আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে উত্তরার বাসার পরিবেশ।  

দশ মাস আগে আবিদ পরিবার নিয়ে উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের ওই বাসায় উঠেন। এর আগে দীর্ঘদিন ছিলেন ৬ নম্বর রোডের ৭ নম্বর বাসায়। পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থাকতেন বয়োবৃদ্ধ স্নেহময়ী শাহানা রহমানের পরিবার। গতকাল তিনিও যান কন্যাতুল্য টপিকে শেষ বিদায় জানাতে। তার কাছে আবিদ ও টপির কথা জানতে চাইতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। অশ্রুধারায় ভিজতে থাকতে কপোল। কান্না সংবরণ করে তিনি বলেন, আবিদের বাবাও পাইলট ছিলেন। তার ছেলে তানজীদও পাইলট হতে চায়। আল্লাহ্‌ তার স্বপ্নপূরণ করুন। ছেলেটা একেবারে এতিম হয়ে গেল। এখন বাবার মৃত্যুর শোক সইতে না পেরে মাও চলে গেল। এখন কী নিয়ে বাঁচবে ছেলেটা। অবশ্য যার কেউ নেই তার আল্লাহ্‌ আছেন। আল্লাহ্‌ই তাকে দেখবেন।

আবিদ-টপির স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, রাত বা ভোরে অফিসের গাড়ি নিতে আসলে আবিদ রাস্তায় বের হতো। বাসায় বিদায় নিয়ে আসার পর বেলকনিতে আসা টপিকে রাস্তা থেকে হাত নেড়ে আবার বিদায় জানাতো। আমি ভাবতাম ছেলেটা বিমান চালাতে যাচ্ছে, ফিরতে পারবে কিনা অনিশ্চয়তা আছে। তাই হয়তো শেষবারের মতো আবারও স্ত্রীকে বিদায় জানাচ্ছে। আর তা-ই আমাদেরকে দেখতে হলো।

২০০৭ সালে কেজি-২তে ভর্তির পর থেকে প্রায় একযুগ ধরে উত্তরার মাস্টারমাইন্ড স্কুলে তানজীদের সঙ্গে পড়ছে শাহরিয়া জালাল মীম। বন্ধুর মা’কে শেষ বিদায় জানাতে উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের মসজিদ পর্যন্ত আসা মীমের কাছে তানজীদের কথা জিজ্ঞেস করতেই সেও কান্নায় বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। অশ্রুতে ছল ছল করতে থাকে দু’চোখ। জড়িয়ে যাচ্ছিলো কথা। নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে মীম বলে, তানজীদের স্বপ্নও ছিল পাইলট হওয়া। সে তার বাবার সঙ্গে বসে বিমান চালানোর স্বপ্ন দেখতো। নতুন মডেলের খেলনার গাড়ি সংগ্রহ করে। তার বাসায় জমা হয়েছে অনেক গাড়ি। পড়াশোনায়ও সে খুব ভালো। আগামী মে’তে অনুষ্ঠিতব্য ও’লেভেলের পরীক্ষায় অংশ নিতে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তার বাবার মৃত্যুর কষ্ট ভুলে থাকতে চেয়েছিল। কষ্ট ভুলতে আজ (শুক্রবার) বসুন্ধরায় মোটর শো-দেখতে যাওয়ার কথা বলেছিল।

তানজীদের অপর বান্ধবী ঐশ্বরিয়া খান ঐশী গতকাল সহপাঠীকে সমবেদনা জানাতে ছুটে যায় উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের ১৮ নম্বর রোডের ৩৪ নম্বর বাসায়। সেখানে ঐশী মানবজমিনকে বলে, আংকেল মারা যাওয়ার পর তানজীদ সিরিয়াস হওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে। বলেছিল পরীক্ষা দিতে হবে। প্রস্তুতি নিতে হবে। তার স্বপ্নও পাইলট হওয়া। সে উড়োজাহাজ প্রকৌশল শিক্ষা ইনস্টিটিউট অ্যারোনটিক্যাল ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশে পড়তে চায়।  

আবিদের পরিবারের ঘনিষ্ঠজন হাসানুজ্জামান আকন্দ স্বপন বলেন, তানজীদ ১০ দিনের মধ্যে বাবা-মা দু’জনকেই হারালো। সবাই তাকে সামলে রাখার চেষ্টা করছে। সে থাকবে তার চাচা প্রফেসর ডা. খোরশেদ মামুদ বাবুর কাছে। তিনি রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালে কর্মরত। স্বামীর মৃত্যুর খবর শুনে অসুস্থ হয়ে পড়লে গত ১৮ মার্চ থেকে টপিকে সেখানেই চিকিৎসা দেয়া হয়। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না তার।

ঢাকার রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের ছাত্র আবিদ সুলতান এক সময় বাংলাদেশ এয়ারফোর্সের পাইলট ছিলেন। পরে ইউএস-বাংলায় যোগ দেন। ছিলেন প্রশিক্ষকও। তার গ্রামের বাড়ি নওগাঁর রাণীনগরে। তার পিতা এমএ কাশেমও ছিলেন ছিলেন পাইলট।
আফসানার চাচা ইয়াদ আলী সাংবাদিকদের বলেন,  ভোরেই আমরা জানতে পারি ওর অবস্থা খারাপের দিকে। আমরা হাসপাতালে যেতে যেতে ওর অর্গানগুলো অকার্যকর হতে থাকে। পরে সাড়ে ৯টায় মারা যায়।

ইউএস-বাংলার ড্যাশ ৮-কিউ ৪০০ এয়ারক্রাফ্‌টটি গত ১২ই মার্চ নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দরে অবতরণের সময় রানওয়ে থেকে ছিটকে পড়ে বিধ্বস্ত হয়। বাংলাদেশ, নেপাল, চীন ও মালদ্বীপের ৬৭ যাত্রীসহ ৭১ আরোহীর ৫১ জন এতে প্রাণ হারায়। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন পাইলট ক্যাপ্টেন আবিদের স্ত্রী আফসানা খানম টপি। পরে আবিদ বেঁচে রয়েছেন জেনে তিনি আশ্বস্ত হয়েছিলেন। কিন্তু পরদিন ১৩ মার্চ মারা যান আবিদ। এতে ভেঙে পড়েন আফসানা। অবনতি হতে থাকে তার অবস্থার। একপর্যায়ে স্বামীর মৃত্যুর শোক সইতে না পেরে গত ১৮ই মার্চ স্ট্রোক করেন। এরপর তাকে উত্তরার একটি ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। পরে সেখান থেকে নেয়া হয় শেরেবাংলা নগরের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালে। পরে আরো একটা মারাত্মক স্ট্রোক করেন। তখন থেকে তাকে রাখা হয় আইসিইউতে। হয় অস্ত্রোপচার। কিন্তু তার অবস্থার অবনতি হতে থাকে। একপর্যায়ে গতকাল সকাল সাড়ে ৯টার দিকে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এরপর গতকাল বেলা ১টা ৩৯ মিনিটে তার লাশ নেয়া হয় তাদের উত্তরার ভাড়া বাসায়। আসরের আগে লাশবাহী এম্বুলেন্স নেয়া হয় উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের মসজিদে। আছরের নামাজের পর অনুষ্ঠিত হয় জানাজা। জানাজা শেষে লাশ নিয়ে এম্বুলেন্স রওনা দেয় বনানীর সামরিক কবরস্থানের দিকে। ১৯শে মার্চ ওই কবরস্থানে সমাহিত হওয়া আবিদের পাশে গতকাল সমাহিত হলো তার প্রিয়তমা আফসানা খানম টপি। বাবার পর মাকেও কবরে রেখে স্বজনদের সঙ্গে ফিরলো তাদের একমাত্র সন্তান তানজীদ বিন সুলতান।

দুর্ঘটনায় নিহত আরো তিনজনের শেষ বিদায়: এদিকে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত ২৬ বাংলদেশির মধ্যে ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে শনাক্ত করে গত বৃহস্পতিবার দেশে আনা হয় মোল্লা আলিফুজ্জামান, মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম ও পিয়াস রায়ের মরদেহ। গতকাল খুলনার গ্রামের বাড়িতে জানাজা শেষে দাফন করা হয় মোল্লা আলিফুজ্জামানের লাশ। রাজশাহীতে নিজ গ্রামে সমাহিত হলেন মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম। আর বরিশাল সদরের শ্মশানঘাটে শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয় সদ্য এমবিবিএস পরীক্ষা শেষ করা পিয়াস রায়ের।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status