বাংলারজমিন
মৌলভীবাজার আওয়ামী লীগ
নতুন কমিটি নিয়ে সাইবার লড়াই
ইমাদ উদ দীন, মৌলভীবাজার থেকে
২৩ মার্চ ২০১৮, শুক্রবার, ৯:১২ পূর্বাহ্ন
দীর্ঘদিন পর নতুন পূর্ণাঙ্গ জেলা কমিটি পেয়েছে মৌলভীবাজার আওয়ামী লীগ। তাই কমিটির তালিকাটি ভাইরাল হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। পক্ষে-বিপক্ষে চলছে সাইবার লড়াই। কমিটি নিয়ে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের স্থানীয় জেলা ও উপজেলার নেতাকর্মীরা ফেসবুকে নানা স্ট্যাটাস দিচ্ছেন। নতুন কমিটি নিয়ে নানা সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা তুলে ধরছেন। নিজ বলয়ের নেতারা কমিটিতে ঠাঁই পাওয়ায় উষ্ণ অভিনন্দন জানাচ্ছেন কেউ কেউ। তাদের পছন্দের নেতার ছবি দিয়ে আগামী দিনের জন্য দোয়া ও আশীর্বাদ চাইছেন। আবার নিজ বলয়ের নেতারা কমিটি থেকে বাদ পড়ায় ক্ষোভও প্রকাশ করছেন অনেকে। তাছাড়া অনেকেই নতুন কমিটিকে একপেশে বলে বিরূপ মন্তব্য করছেন। সাবেক কমিটির অনেকেই একই পদে পুনর্বহাল এবং গুরুত্বপূর্ণ অনেকেই কমিটি থেকে বাদ পড়ায় বিরূপ প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করছেন। বলছেন এরকম একপেশে নেতাকর্মীদের দিয়ে কমিটি হওয়ায় জেলা জুড়ে আগের মতো সাংগঠনিক কাজ ঝিমিয়ে পড়বে। জেলা কমিটিতে দলের অনেক নিবেদিত প্রাণ নেতাকর্মীরা ঠাঁই না পাওয়ায় মান অভিমান আর ক্ষোভে তারা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বেন। শুক্রবার দুপুরে দলের জেলা কমিটির তালিকা পৌঁছার পর থেকে ফেসবুকে এমন নানা মন্তব্যপূর্ণ স্ট্যাটাস চলছে। নতুন কমিটি নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। বলতে গেলে নতুন কমিটি নিয়ে নিজ দলের বিবাদমান দুই গ্রুপের মধ্যে চলছে সাইবার যুদ্ধ। জানা যায় অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে দীর্ঘ প্রায় এক যুগ পর ২০১৭ সালের ২৮শে অক্টোবর হয় মৌলভীবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন। মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে আয়োজিত ওই সম্মেলনকে ঘিরে উজ্জীবিত ছিলেন নেতাকর্মীরা। প্রত্যাশা ছিল ওই দিন কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে তাদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবে জেলা কমিটি। আর চিরতরে অবসান হবে জেলা জুড়ে প্রকাশ্যে বিভক্ত থাকা দুটি গ্রুপের। কিন্তু হয়নি কাউন্সিল। হতাশ হন সম্মেলনে আসা দলের তৃণমূলের ত্যাগী নেতাকর্মীরা। জানা যায়, ওই দিন সন্ধ্যায় দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কাউন্সিল ছাড়াই সভাপতি সম্পাদকসহ ১১ জনের আংশিক কমিটি ঘোষণা দেন। আর দ্রুততম সময়ের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটির তালিকা আলোচনার ভিত্তিতে সকলের সমন্বয়ে প্রস্তুত করার জন্য উভয় গ্রুপের ১১ সদস্যের ওপর মৌখিক দায়িত্ব দেন। কিন্তু দলের দীর্ঘদিনের বিবাদমান দু’টি গ্রুপের নেতাকর্মীরা ঠিক আগেরমতই দ্বন্দ্বের কারণে একসঙ্গে বসতে না পারায় সমঝোতার ভিত্তিতে পূর্ণাঙ্গ জেলা কমিটি কেন্দ্রে অনুমোদনের জন্য পাঠানো সম্ভব হয়নি। এনিয়ে ভেতরে ভেতরে জিয়ে থাকা পুরনো দ্বন্দ্ব আবারো উসকে উঠে। প্রয়াত সমাজ কল্যাণমন্ত্রী মহসীন আলী গ্রুপের নেতাকর্মীদের অভিযোগ একই বলয়ের (তাদের প্রতিপক্ষ গ্রুপের) নতুন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হওয়ায় তাদের না ডেকে কোনো সুপারিশ বা পরামর্শ না নিয়ে একতরফা তাদের আত্মীয় স্বজন ও গ্রুপ সমর্থক দিয়ে নতুন পূর্ণাঙ্গ জেলা কমিটি অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রে পাঠান। যারা কোনো দিনও আওয়ামী লীগ করেননি এমনকি উপজেলা কিংবা ইউনিয়ন কমিটিতেও নাম নেই এমন অনেকেই আত্মীয়তার সুবাদে দলের জেলা কমিটিতে ঠাঁই পেয়েছেন। জেলা জুড়ে নিজেদের বলয় ধরে রাখতে এমন কুট কৌশল করেছেন। তারা বলেন, তাদের ওই পকেট কমিটি কেন্দ্রে পৌঁছালে আমরা জানতে পারি। তখন দলের স্বার্থে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের অনুরোধে সকলকে নিয়ে বসে তাদের মতামতের ভিত্তিতে একটি গ্রহণযোগ্য কমিটি কেন্দ্রে পাঠাই। কিন্তু তারা নানাভাবে প্রভাবিত করে তাদের পাঠানো কমিটির অনুমোদন নিতে মরিয়া হয়ে উঠে। বাদ পড়ে আমাদের প্রেরিত কমিটির তালিকা। তারা বলেন, জেলা জুড়ে দলের সাংগঠনিক কাজ আরো বেগবান করতে ও দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মতামতকে মূল্যায়ন করতে আমরা শিগগিরই ওই পকেট কমিটি বাতিলের জন্য দলের সভাপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা দেশরত্ন জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবেদন করবো। কারণ একপেশে ওই কমিটি বাতিল না হলে দলের সাংগঠনিক কাজে স্থবিরতা আসবে। তারা জানান, জেলার বিভিন্ন উপজেলার হতাশাগ্রস্ত নেতাকর্মীরা প্রতিক্রিয়ায় বলছেন ওই পকেট কমিটি থাকলে তারা দলীয় রাজনীতিতে আর সক্রিয় হবেন না। আমরা অভয় দিয়ে বলেছি বিষয়টি কেন্দ্রীয় কমিটিকে অবগত করবো। অবশ্যই বিষয়টি দলের স্বার্থে বিবেচিত হবে। তবে এমন অভিযোগ মানতে নারাজ বর্তমান সভাপতি গ্রুপ। তাদের দাবি কেন্দ্র কমিটি দলের স্বার্থেই এই কমিটির অনুমোদন দিয়েছে। ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া নতুন জেলা কমিটির তালিকার দেখা যায় শেষ পৃষ্ঠার নিচ অংশে অনুমোদিত কলামে দলের সভাপতি শেখ হাসিনার স্বাক্ষরের তারিখ দেয়া ১-১২-২০১৭। কিন্তু কমিটি অনুমোদন হয়েছে চলতি বছরের ১৫ই মার্চ। আর দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের স্বাক্ষরে কোনো তারিখ নেই। শুধু চিঠির উপরে ১৫ই মার্চ ২০১৮ উল্লেখ রয়েছে। উপরের অংশে ২০১৭-২০২০ সালের উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ দলের গঠনতন্ত্রে বলা হয়েছে কমিটি হবে ত্রিবার্ষিক। আর ক্রমিক নম্বরগুলোরও ধারাবাহিকতা নেই। সবই এলোমেলো অগোছালো। ক্রমিক নং ৩৭ থেকে সদস্য শুরু হলেও ৪০ নম্বরে সভাপতির নাম। আবার ক্রমিক নং ৪০ নম্বরেও দেখা যাচ্ছে আরেকজন সদস্যদের নাম। ৭৮ সদস্যের কমিটি হলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া কপিতে দেখা যাচ্ছে ৭৫ জনের নাম। ক্রমিক নং ১-৩৬ পর্যন্ত কাদের নাম আছে তারও কোনো বর্ণনা নেই। আর ক্রমিক নং ৩৯ মো. ফিরুজের নাম সদস্য পদে থাকলেও তালিকার একটি পৃষ্ঠায় শেষের দিকে নির্দিষ্ট কলামের বাহিরে তাকে জাতীয় কমিটির সদস্য উল্লেখ করা হয়েছে। এটি জাতীয় কমিটি নাকি জাতীয় পরিষদ সে বিষয়টি স্পষ্ট না হওয়াতে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে নেতাকর্মীরা। অনেকেই বলছেন এই তালিকাটি আসলেই দলের সভাপতি ও সম্পাদক স্বাক্ষরিত কিনা? নাকি এর আড়ালে অন্য কিছু। নতুন কমিটি নিয়ে জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য ও যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি বিশিষ্ট শিল্পপতি এম এ রহিম (সি আইপি) বলেন, ১৯৬৯ সাল থেকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতিতে আছি। ৭৫ পরবর্তী জেলা ছাত্রলীগকেও সু-সংগঠিত করি। ওয়ান ইলিভেনের সময় দলের দুর্দিনে দেশে-বিদেশে আন্দোলন করেছি। দেশরত্ন গণতন্ত্রের মানস কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে জন্মভূমির টানে স্থায়ীভাবে দেশে এসেও কাজ করছি। কিন্তু জেলা কমিটিতে কৌশলে আমাকে বাদ দেয়া হয়েছে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, কমিটিতে দলের কেউ নয় এমনও অনেকে আছেন যারা আত্মীয়তার সুবাদে ঠাঁই পেয়েছেন। জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সৈয়দ মফচ্ছিল আলী বলেন, দ্রুত সময়ে জেলার নতুন কমিটি অনুমোদন পাওয়ায় নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত হয়েছেন। নেতাকর্মীরা এই কমিটিকে স্বাগত জানাচ্ছেন। জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও সাবেক কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুর রহমান বাবুল বলেন, নতুন কমিটি নিয়ে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা নানা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন। একপেশে কমিটি নেতাকর্মীদের মধ্যে কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবে তা দেখার বিষয়। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নেছার আহমদ বলেন, কেন্দ্র প্রেরিত জেলা কমিটির অনুমোদনের কপিটি হাতে এসে পৌঁছেছে। তালিকাতে কিছুটা অসঙ্গতির থাকার কথা উল্লেখ করে বলেন, এগুলো ছাপার ত্রুটি। নতুন কমিটি আত্মীয়করণের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, যারাই কমিটিতে স্থান পেয়েছে তারা দলের সুদিনে দুর্দিনে নিবেদিত ছিলেন। তিনি বলেন, আমাদের প্রেরিত তালিকাটিই কেন্দ্র অনুমোদন দিয়েছে। বড় দল তাই ইচ্ছা থাকলেও সকলকে কমিটিতে রাখার কোনো সুযোগ নেই। জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও প্রয়াত সমাজ কল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মহসীন আলীর স্ত্রী সৈয়দা সায়রা মহসীন এমপি বলেন, নতুন ওই কমিটিতে দলের অনেক ত্যাগী নেতাকর্মীরা স্থান পায়নি। বরং যারা দেশের বাহিরে আছে কিংবা নিষ্ক্রিয় তাদের আত্মীয়তার সুবাদে দলে ঠাঁই দেয়া হয়েছে।