বিশ্বজমিন

‘রেক্সিট’ পরবর্তী মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি

ইকোনমিস্ট

২১ মার্চ ২০১৮, বুধবার, ১০:১৫ পূর্বাহ্ন

এই হোয়াইট হাউজকে তুলনা করা যায় রিয়েলিটি টিভি অনুষ্ঠানের সঙ্গে। যখন তখন, যাকে তাকে বরখাস্ত করা হচ্ছে। কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসনকে যেভাবে বরখাস্ত করা হলো, তা দেখে চমকে যেতে হয়। প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প তাকে এক টুইটার বার্তায় বরখাস্ত করেছেন। পাশাপাশি বলেছেন যে, তার স্থলাভিষিক্ত হবেন সিআইএ পরিচালক মাইক পম্পেও। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীকে বরখাস্তের সময় তাকে ফোন পর্যন্ত করেন নি প্রেসিডেন্ট। করেছেন বরখাস্ত করার অনেক পরে। এমনকি ব্যাখ্যাও দেন নি কেন তাকে সরিয়ে দেওয়া হলো। টিলারসনের মুখপাত্র বলেছেন, তার বসকে কেন যে বরখাস্ত করা হলো, সে ব্যাপারে তার কোনো ধারণাই নেই। ক’দিন বাদে এই মুখপাত্রকেও বরখাস্ত করা হয়।
রেক্স টিলারসন একজন নি¤œমানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। রাজনীতিতে আসার আগে তিনি ছিলেন এক্সন মবিলের নেতৃত্বে। এই প্রতিষ্ঠানটি আয়ের দিক থেকে বিশ্বের দশম বৃহত্তম কোম্পানি। কূটনীতিকে তিনি ব্যবসা পরিচালনার মতো বিবেচনা করেছিলেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে তিনি কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের একটি বিভাগ হিসেবে দেখেছেন। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মতোই তিনি হয়তো নিজের অধস্তন কিছু শীর্ষ কর্মকর্তাকে বিবেচনা করেছিলেন অলস কর্মী হিসেবে। এই কর্মকর্তারা টিলারসনকে বেশ কড়া ভাষায় সমালোচনা করেছেন। শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট তাকে ছাঁটাই করলেন। অবশ্য, প্রেসিডেন্টকে ‘বেকুব’ বলার কথা খবরে আসার পরই তাকে বরখাস্ত হতে হলো।  
নতুন যেই ব্যক্তি টিলারসনের স্থলাভিষিক্ত হলেন, সেই মাইক পম্পেও নিজেকে প্রেসিডেন্টের চোখে একজন ‘ট্রাম্পিয়ান’ হিসেবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। ট্রাম্পের মতো, তিনিও ‘আগে আমেরিকা’ বিশ্বনীতিতে বিশ্বাসী। তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার পর, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি হয়তো আরও সমন্বিত হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও হোয়াইট হাউজের মতবিরোধ প্রকাশ্যে আসবে না। কিন্তু বর্তমানে আমেরিকার পররাষ্ট্র নীতির সবচেয়ে বড় দুই চ্যালেঞ্জের কথা ভাবলে আপনি দেখবেন যে, পম্পেও ও ট্রাম্প জুটি নিয়ে আশ্বস্ত হওয়ার উপায় নেই।
প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো উত্তর কোরিয়া। উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার মাধ্যমে দর কষাকষির আলোচনা শুরু করার যে সিদ্ধান্ত ডনাল্ড ট্রাম্প নিয়েছেন, সেটা রীতিবিরুদ্ধ। আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে করমর্দনের একটি ছবি কিম জং উনের জন্য বিশাল সাফল্য। কোনো ধরণের অগ্রগতি না এনেই ডনাল্ড ট্রাম্প এই সুযোগ উত্তর কোরিয়াকে হাতে তুলে দিয়েছেন। এটি যে খারাপ কৌশল, তা হলফ করে বলা যায় না। কারণ, উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সমঝোতার অন্যান্য কৌশল অতীতে ব্যর্থ হয়েছে।
সমস্যা হলো, কোরিয়ান উপদ্বীপকে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত করার আলোচনা হতে হবে অত্যন্ত সংবেদনশীল, জটিল ও কৌশলী উপায়ে। কিন্তু ট্রাম্প খুবই আবেগপ্রবণ ও সবসময় নিজেকে নিয়ে মেতে থাকেন। এই সপ্তাহে টিলারসনকে বরখাস্ত করা থেকেও তা প্রতীয়মান হয়। অপরদিকে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক প্রকল্পের খুঁটিনাটি জানা ও একে কীভাবে অকার্যকর করতে হবে, তা বোঝার জন্য গভীর পা-িত্য প্রয়োজন। উত্তর কোরিয়ার প্রতারণা করার সুযোগ বন্ধ করে কোনো চুক্তি করতে হলে, সেই চুক্তি হতে হবে পুঙ্খানুপুঙ্খ ও দীর্ঘস্থায়ী।
সেই হিসাবে আমেরিকার অবশ্যই তার মিত্র দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের নিরাপত্তা লঘু করার বিনিময়ে নিজের নিরাপত্তা জোরদার করা চলবে না। যদি আলোচনা থেকে কিছুই না আসে (যার সম্ভাবনাই বেশি), তাহলে উভয় পক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে যে, ব্যর্থ আলোচনা থেকে নতুন কোনো সংঘাত যাতে তৈরি না হয়।
কিন্তু এসব সুক্ষ্ম বিষয়াদি ট্রাম্পের স্টাইলের সঙ্গে যায় না। সঠিকভাবে পরিচালিত কোনো প্রশাসনে, এ ধরণের সুক্ষ্ম বিষয় ছেড়ে দেওয়া হতো অধস্তন কর্মকর্তাদের ওপর। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দক্ষিণ কোরিয়ায় এই মুহূর্তে আমেরিকার কোনো রাষ্ট্রদূত নেই। শূন্য আছে আন্ডার সেক্রেটারি ফর আর্মস কন্ট্রল পদটিও। এসব পদে কেউ থাকলেও, ট্রাম্প যে তাদেরকে সময় দিতেন, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। প্রেসিডেন্টের মধ্যে এক ধরণের প্রবণতা কাজ করে যে, শুধু তিনি একাই যুগান্তকারী কোনো চুক্তির মধ্যস্থতা করে ফেলতে পারবেন। এখানে ঝুঁকিটা হলো, পম্পেও হয়তো বসকে খুশি রাখতে তার সঙ্গে একমত হয়ে যাবেন।
আমেরিকান পররাষ্ট্রনীতির দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হলো একটি পারমাণবিক চুক্তি যেটি ভ-ুল করতে ট্রাম্প প্রশাসন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আসছে মে মাসে তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন এই চুক্তিতে তিনি অটল থাকবেন নাকি একে ছুড়ে ফেলবেন। চুক্তিটা হলো ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে। টিলারসন এই চুক্তি বহাল রাখার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু পম্পেও অনেক রিপাবলিকানের মতো এই চুক্তির বিরোধীতা করছেন দীর্ঘদিন ধরে। তাই এই চুক্তি থেকে ট্রাম্প প্রশাসন আমেরিকাকে প্রত্যাহার করাবে তার সম্ভাবনাই বেশি। তা হবে একটি ভুল সিদ্ধান্ত।
কোনো চুক্তির প্রসঙ্গ উঠলেই ট্রাম্প সবসময়ই মনে করেন যে, তিনি আরও ভালো চুক্তি আদায় করতে পারতেন। বিশেষ করে, তার পূর্বসূরি বারাক ওবামা যেসব চুক্তি করেছেন, সেসবের বেলায় তার মধ্যে এই প্রবণতা আরও বেশি কাজ করে। কিন্তু ইরান চুক্তি হলো বহু কঠিন আলোচনা, দর কষাকষির পর বাস্তবে রূপ নেওয়া একটি চুক্তি।  এই চুক্তিতে ফের বড় ধরণের পরিবর্তন আনার সুযোগ কম। এই চুক্তি নিয়ে আলোচনা পুনরায় শুরু করে আমেরিকা ইরানকে তার আঞ্চলিক উচ্চাভিলাশ থেকে বিরত রাখতে পারবে, এমন সম্ভাবনা প্রায় নিশ্চিতভাবেই শূন্য।
আমেরিকা যদি এই চুক্তি থেকে চলে যায়, আমেরিকার ইউরোপিয়ান মিত্ররা এই চুক্তিতে রয়ে যাবেন। কিন্তু ইউরোপ এই অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছাবে যে, আন্তঃআটলান্টিক মৈত্রীর প্রতি ট্রাম্পের অঙ্গীকার অত্যন্ত দুর্বল। আমেরিকা চলে গেলেই ইরান পারমাণবিক চুক্তি ভেস্তে যাবে, তা নয়। কিন্তু সেক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যে পারমাণবিক অস্ত্র নির্মানেণর প্রতিযোগিতার ঝুঁকি বৃদ্ধি পাবে। সৌদি আরব ও মিশর ইতিমধ্যেই ওই দিনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে দিয়েছে যেদিন ইরানের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র থাকবে।
শুধু তা-ই নয়। ইরান চুক্তি থেকে আমেরিকা চলে গেলে, উত্তর কোরিয়াও নিশ্চিতভাবেই ট্রাম্পকে বিশ্বাস করার কথা কম করে ভাববে।
প্রেসিডেন্টের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এইচ আর ম্যাকমাস্টার, যিনি নিজেও শিগগিরই বরখাস্ত হতে পারেন, অথবা প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জেমস ম্যাটিস হয়তো প্রেসিডেন্টকে ইরান চুক্তি ভ-ুল করা থেকে বিরত রাখতে পারেন -- এমন আশা হলো খড়কুটো ধরে বেঁচে থাকার চেষ্টা করার সমান। বিশ্বের প্রতি ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি প্রোথিত আছে এই বিশ্বাসের ওপর যে, আমেরিকাকে জিতাতে হলে অন্যদেরকে অবশ্যই হারতে হবে। তিনি শুল্ক আরোপ করেছেন। তিনি উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছেন। শিগগিরই হয়তো মধ্যপ্রাচ্য শান্তি পরিকল্পনা উপস্থাপন করবেন। বিশ্ব হয়তো বাধাহীন উদ্যোম এক ট্রাম্পকে প্রত্যক্ষ করতে চলেছে।
(লন্ডন-ভিত্তিক ইকোনমিস্ট ম্যাগাজিনে প্রকাশিত আমেরিকান ফরেইন পলিসি আফটার রেক্সিট-এর অনুবাদ।)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status