বাংলারজমিন

করতোয়ার বুকে এখন মানুষের বিল্ডিং

প্রতীক ওমর, বগুড়া থেকে

২১ মার্চ ২০১৮, বুধবার, ৮:০৯ পূর্বাহ্ন

ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ আছড়ে পড়তো দুই তীরে। নির্মল স্বচ্ছ পানিতে ¯্রােতের গতি, কলকল শব্দ মানুষকে কাছে টানতো। দুরন্ত কিশোরের দল ঝাঁপিয়ে পড়তো নদীর বুকে। ¯্রােতের সঙ্গে গা ভাসিয়ে মিতালি করতো নদীর সঙ্গে। চেলা মাছ, বোয়াল মাছ ধরার উৎসব হতো। মাঝিমাল্লারা ভাটিয়ালি, জারিগান, সারিগান গেয়ে নৌকা বাইতো। প্রতিবছর বর্ষার শেষে নৌকা বাইচের আয়োজন হতো। গায়ের কুলোবধূরা তপ্ত দুপুরে টুপটুপ ডুব দিতো স্রোতশ্বিনী নদীর বুকে। কৃষকের ঘাম ঝরা শরীর, হালের বলদ, দুধ দেয়া গাই গরু এক সঙ্গে নদীতে ভাসার দৃষ্টিনন্দন দৃশ্যে ভেসে উঠতো পুরো বাংলাদেশ। আমি করতোয়া বলছি, আমি এখন মৃত। ভরা বর্ষাতেও পানিশূন্য থাকে করতোয়া। আমার বুকে এখন মানুষের বিল্ডিং। মানুষের উচ্ছিষ্ট, মানুষের ময়লা। মাত্র কিছুদিন আগে ১৯৮৮ সালেও করতোয়ার যৌবন ছিলো টইটম্বুর। বরেন্দ্র অঞ্চলের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া এই করতোয়ার পানিতে হাজার হাজার একর জমিতে ফসল ফলতো। বগুড়া তখন পুন্ড্রনগর হিসেবে মানুষ চিনতো। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে এই পুন্ড্রনগর গড়ে ওঠে করতোয়ার কোল ঘেঁষেই। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সওদাবাহী শতশত নৌকা ভিড়তো পুন্ড্রনগরের তীরে। সুদূর খুলনা থেকে নারকেল, ইলিশ আসতো। এখান থেকে যেত কাঁচা সবজিসহ অনেক কৃষি পণ্য। ব্যবসা বাণিজ্যের প্রচার প্রসার ঘটে এই নদীকে কেন্দ্র করেই। সড়ক পথের চেয়ে অন্তত তিন ভাগ টাকা বেঁচে যেত নদীপথে পণ্য বহনের ক্ষেত্রে। বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়িক শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরির ফলে আস্তে আস্তে পুন্ড্রনগরের পরিধি বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে নগর সভ্যতা। এক সময় ব্যবসায়িক অবকাঠামো মজবুত হয়ে ওঠে। করতোয়া নদীর অববাহিকায় গড়ে ওঠে দৃষ্টিনন্দন দালান। পাকা রাস্তা। সঙ্গে সবুজ প্রকৃতি। করতোয়াপাড়ের প্রবীণ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই নদীতে এক সময় পাওয়া যাচ্ছিল ঝাঁকে ঝাঁকে চেলা মাছ। বগুড়া শহরের হার্ড পয়েন্ট চেলোপাড়া নামকরণ হয়েছে নদীর চেলা মাছের ঝাঁক থেকেই। এই চেলোপাড়া পয়েন্ট সেই সময় জেলেরা জাল পেতে এই চেলা মাছ ধরতো। সেই থেকেই এই জায়গার নাম হয়েছে চেলোপাড়া।
শুধু করতোয়া নয় নদী মাতৃক বাংলাদেশে অনেক নদীর অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। দুইশ কিলোমিটার দীর্ঘ এক সময়ের খরস্রোতা করতোয়া এখন পরিণত হয়েছে মরা খালে। আর এই নদীর তীর ঘেঁষে নগর সভ্যতা হিসেবে পুন্ড্রনগরীর গোড়া পত্তন হলেও সেই নদীই এখন প্রতিনিয়ত দূষণ করছে বগুড়া শহর। এতে এক দিকে যেমন শহর সৌন্দর্য হারাচ্ছে তেমনি পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। সেই করতোয়া এখন মরা কঙ্কাল।
১৯৮৮ সালে ভয়াবহ বন্যার সময় তৎকালীন এরশাদ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা সদরের খুলশিচাঁদপুর এলাকার কাটাখালিতে বাঁধ ও স্লুইস গেট নির্মাণের মাধ্যমে করতোয়া নদীর গতিপথ পরিবর্তন করা হয়। কাটাখালি থেকে করতোয়ার পথপরিবর্তন হয়ে পূর্ব দিকে গিয়ে বাঙালি নদে মিলিত হয়েছে। আর কাটাখালি থেকে বগুড়ার দিকে প্রবহমান করতোয়া তখন থেকেই মারা যেতে শুরু করেছে। নদীটির গাইবান্ধা অংশে এখনো পানির দেখা মিললেও বগুড়া অংশের চিত্র একেবারেই উল্টো। বর্ষা মৌসুমেও এখানে হাঁটু পানি থাকে। নদীতে পানি ও স্রোত না থাকায় এবং শহরের ময়লা আবর্জনা নদীতে পড়ে ভরাট হতে থাকে করতোয়া। ভরাট হওয়া নদীর বুকে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা তুলতে থাকে বড় বড় বিল্ডিং। বগুড়া শহরের উত্তর প্রান্ত নদীর ঠেঙ্গামারা থেকে শুরু করে শহরের দক্ষিণ প্রান্ত এলাকা জুড়ে নদীটির বেশির ভাগ এখন ভূমিদস্যুদের দখলে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাঝে মাঝে দখলমুক্ত করার লোক দেখানো ঝটিকা অভিযান চালালেও গরিব শ্রেণির সাধারণ মানুষের দুই চারটি টিন সেট ঘর ভাঙা ছাড়া আসল জায়গাগুলোতে কোনো দিন হাত দেয়নি। প্রভাবশালী ব্যক্তি অথবা প্রতিষ্ঠানগুলো করতোয়া দখল করে যেসব বড় বড় বিজনেস সেন্টার তৈরি করেছে তাদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থাও নেয়নি প্রশাসনের পক্ষ থেকে। ফলে দিন দিন নদীর অবশিষ্ট অংশটুকুও এই সব প্রভাবশালীদের দখলে চলে যাচ্ছে।
অপরদিকে দীর্ঘদিন ড্রেজিং না করায় শহরের সমস্ত ময়লা আবর্জনা নদীর তলদেশে জমে পচে এলাকায় দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। ফলে নদীপাড়ে বসবাসরত মানুষের শরীরে নানা ধরনের ঘা পচড়া, চুলকানিসহ চর্ম রোগ হচ্ছে। নদীপাড়ে গড়ে ওঠা স্কুল ও কলেজে আসা ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষক ও অভিভাবকদের প্রতিনিয়তই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
করতোয়া নদীর উৎপত্তি নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার নিচু জলা ভূমি হতে। যেটি দিনাজপুরের পার্বতীপুর ও নবাবগঞ্জ উপজেলার মধ্য দিয়ে রংপুরের বদরগঞ্জ এবং গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ হয়ে বগুড়ার শিবগঞ্জের ভেতর দিয়ে শহরের বুক চিরে জেলার শেরপুর উপজেলার চান্দাইকোনায় বাঙালি নদীতে গিয়ে মিশেছে। উৎপত্তিস্থল থেকে এর দৈর্ঘ্য ২০০ কিলোমিটার। এরমধ্যে দখল আর ভরাটের কারণে এখন মরতে বসেছে বগুড়া এলাকার প্রায় ৪০ কিলোমিটার নদী।
সরু খাল আকারের যে নদী চিহ্ন বিদ্যমান সেখানে শহরের কল-কারখানা ও গৃহস্থালীর দূষিত বর্জ্য ফেলার কারণে নদীর বুকে যৎসামান্য যে পানির চিহ্ন চোখে পড়ে তা এতোটাই দূষিত যে সেখানে কোনো মাছ পাওয়া যায় না। এই দূষিত পানি ব্যবহারের কারণে নদী তীরবর্তী এলাকার জনসাধারণকে প্রতিনিয়ত নানা রোগে ভুগতে হচ্ছে।
খরস্রোতা করতোয়ার সঙ্গে এক সময় শৈশব পার করেছেন ভাষা সৈনিক রেজাউল করিম। তিনি করতোয়া সম্পর্কে বলেন, করতোয়ার পানির সঙ্গেই আমার শৈশব পার করেছি। এখনো চোখ বন্ধ করলে করতোয়ার শব্দ আমার কানে ভাসে। হাজারো স্মৃতি মিশে আছে এই নদীর বুকে। আমি মৃত এই করতোয়া নদীকে বাঁচানোর জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান করছি। সঙ্গে দাবি জানাচ্ছি দ্রুত দূষণ ও দখল মুক্ত করে এবং গোবিন্দগঞ্জের বাঁধ ও স্লুইস গেট খুলে দিয়ে করতোয়াকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেয়া হোক।
বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ জানান, করতোয়া নদী দখলমুক্ত করার বিষয়টি জেলা প্রশাসক দেখেন। তিনি আরো বলেন, করতোয়া নদী খনন এবং দূষণমুক্ত করার একটি প্রকল্প তৈরি হচ্ছে। অচিরেই সেই ফাইল প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে যাবে। ওই প্রকল্প পাস হলে করতোয়ার দুই তীর দখলমুক্ত করে দৃষ্টিনন্দন বগুড়া গড়ার কাজ শুরু করতে পারবেন বলে জানান তিনি।

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status