প্রথম পাতা

বিদায় পদার্থ বিজ্ঞানের কবি

মানবজমিন ডেস্ক

১৫ মার্চ ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৯:৫৭ পূর্বাহ্ন

১৯৬৩ সাল। তার বয়স তখন মাত্র ২২। চিকিৎসকরা বলে দিলেন, সর্বোচ্চ দুবছর পৃথিবীর আলো দেখবেন। কিন্তু না। তিনি লড়ে গেলেন। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের রহস্য হাতড়ে নিজেই পৃথিবীকে আলোকিত করে গেলেন। প্রাণঘাতী স্নায়ুরোগ মটোর নিউরনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দৃষ্টান্ত রেখে গেলেন, সারাজীবন হুইলচেয়ারে সীমাবদ্ধ থেকেও মহাশূন্যে বিচরণ করা যায়। অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের পর আর কোন পদার্থবিদ মর্যাদার এমন উচ্চতায় পৌঁছুতে পারেননি। বিজ্ঞানের প্রাজ্ঞ শ্রেণী ছাপিয়ে বিশ্বজুড়ে সাধারণ মানুষের মনে দাগ কাটতে পারেননি। অনবদ্য সেই স্টিফেন হকিং অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটেছে। গতকাল মৃত্যুবরণ করেছেন কিংবদন্তি এই পদার্থবিজ্ঞানী। বৃটেনের কেমব্রিজে স্থানীয় সময় ভোররাতে নিজ বাড়িতে ৭৬ বছর বয়সে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।

হকিং অধ্যায়ের শুরু ও শেষটাও কিভাবে যেন আবদ্ধ হলো অঙ্ক আর রহস্যঘেরা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অদ্ভুত এক যোগসূত্রে। তার জন্ম ও মৃত্যু তারিখের সঙ্গে জুড়ে আছে বিজ্ঞানের আরো দুই কিংবদন্তির নাম। হকিংয়ের জন্ম তারিখ ৮ই জানুয়ারি গ্যালিলিও গ্যালিলির মৃত্যুদিন। আর মৃত্যুর তারিখ ১৪ই মার্চ হলো অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের জন্মদিন। একইসঙ্গে এ দিনটি পাই দিবস হিসেবে স্বীকৃত। পাইয়ের মান ৩.১৪ বছরের এ একটি তারিখেই দেখা যায় (তৃতীয় মাসের চতুর্দশ দিন)।  

গতকাল প্রফেসর স্টিফেন হকিংয়ের তিন সন্তান লুসি, রবার্ট ও টিম এক বিবৃতিতে তাদের পিতার মৃত্যুর খবর জানান গণমাধ্যমকে। বলেন, আমাদের প্রাণপ্রিয় পিতা আজ (বুধবার) আমাদেরকে ছেড়ে চিরবিদায় নিয়েছেন। তাকে হারিয়ে আমরা গভীরভাবে বেদনাহত। তিনি ছিলেন একজন মহান বিজ্ঞানী। আর মানুষ হিসেবে অসাধারণ। তার কীর্তি টিকে থাকবে বহু বছর। তার মেধাবী অধ্যবসায় ও সাহস সারাবিশ্বের মানুষকে উৎসাহিত করেছে। আমরা তাকে চিরদিন মিস করবো। বিবৃতিতে হকিংয়ের তিন সন্তান কৃতজ্ঞতা জানান, এতটা বছর তার পাশে যারা ছিলেন, তাকে যারা সমর্থন দিয়ে গেছেন, তাদের সবার প্রতি। জগদ্বিখ্যাত এই পদার্থবিদ, জ্যোতির্বিদ, গণিতজ্ঞ মোটর নিউরণ রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর তার কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র বিকল হয়ে যায়। এরপর থেকে তার পুরো জীবনটাই কেটেছে হুইলচেয়ারে। পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়েও স্পিচ সিন্থেসাইজারের মাধ্যমে কথা বলতেন তিনি। কম্পিউটারইজড বিশেষ ওই হুইল চেয়ারে বসেই পার করেছেন বর্ণাঢ্য এক জীবন। চালিয়ে গেছেন গবেষণা। মনের জগতে বিচরণ করেছেন অন্তরীক্ষ। সেখানেই আটকে থাকেননি। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়েই মহাকাশ ভ্রমণে গেছেন। মহাবিশ্বের উৎসের সন্ধানে সারাজীবনের গবেষণায় সমৃদ্ধ করেছেন পদার্থ ও মহাকাশবিজ্ঞান। পৃথিবীকে দিয়েছেন বিস্ময়কর সব তত্ত্ব। আর তাই মহান বিজ্ঞানী স্যার আলবার্ট আইনস্টাইনের পর তিনিই হয়ে ওঠেন সবচেয়ে সেরা পদার্থবিজ্ঞানী। ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত তার লেখা বেস্ট সেলার ‘এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’  কোটিরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে। ২০১৪ সালে তাকে নিয়ে তৈরি হয়েছে চলচিত্র। ‘দ্য থিওরি অব ইভরিথিং’ নামের ছবিটি মনোনীত হয় একাধিক অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডের জন্য।

ছেলে বেলা: গ্যালিলিওর মৃত্যুর ঠিক তিনশত বছর পরে হকিংয়ের জন্ম হয় অক্সফোর্ডে। তার পিতা ড. ফ্রাঙ্ক হকিং একজন জীববিজ্ঞান গবেষক ও মা ইসাবেল হকিং একজন রাজনৈতিক কর্মী। হকিংয়ের বাবা-মা উত্তর লন্ডনে থাকতেন। লন্ডনে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজছে। হকিং গর্ভে আসার পর নিরাপত্তার খাতিরে তারা অক্সফোর্ডে চলে যান। হকিংয়ের জন্মের পর তারা আবার লল্ডনে ফিরে আসেন। ফিলিপ্পা ও  মেরি নামে হকিংয়ের দুই বোন রয়েছে। এছাড়া হকিং পরিবারে এডওয়ার্ড নামে এক পালকপুত্রও ছিল। হকিংয়ের বাবা-মা পূর্ব লন্ডনে বসবাস করলেও ইসাবেল গর্ভবতী থাকার সময় তারা অক্সফোর্ডে চলে যান। সে সময় জার্মানরা নিয়মিতভাবে লন্ডনে বোমাবর্ষণ করতো। হকিংয়ের একটি প্রকাশনা থেকে জানা গেছে, তাদের বসতবাড়ির কয়েকটি গলি পরেই জার্মানির ভি-২ মিসাইল আঘাত হানে।

স্টিফেনের জন্মের পর তারা ফের লন্ডনে চলে যান। সেখানে স্টিফেনের পিতা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর মেডিক্যাল রিসার্চের প্যারাসাইটোলজি বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫০ সালে হকিংদের পরিবার হার্টফোর্ডশায়ারের সেন্ট অ্যালবাতে চলে যান। ১৯৫০  থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত হকিং  সেন্ট অ্যালবার  মেয়েদের স্কুলে পড়েন।  সে সময় ১০ বছর বয়স পর্যন্ত ছেলেরা মেয়েদের স্কুলে পড়তে পারতো। পরে সেখান থেকে ছেলেদের স্কুলে চলে যান। স্কুলে তার রেজাল্ট ভালো ছিল বটে তবে অসাধারণ ছিল না। স্কুলের শিক্ষকদের মধ্যে গণিত শিক্ষক ডিকরান তাহতার অনুপ্রেরণার কথা হকিং পরবর্তী জীবনে স্মরণ করেন। পরবর্তী সময়ে হকিং স্কুলের সঙ্গে তার সম্পর্ক বজায় রাখেন। নিজের নামে স্কুলের চারটি হাউসের একটি ও সহপাঠের লেকচার সিরিজের নাম দেন। স্কুল ম্যাগাজিন ‘দি অ্যালবানিয়ান’-এ দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দেন।

বিজ্ঞানে হকিংয়ের সহজাত আগ্রহ ছিল। হকিংয়ের পিতার ইচ্ছে ছিল হকিং যেন তার মতো ডাক্তার হন। কিন্তু হকিং গণিত পড়ার জন্য অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিভার্সিটি কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু যেহেতু  সেখানে গণিতের কোর্স পড়ানো হতো না, সেজন্য হকিং পদার্থবিজ্ঞান বিষয় নিয়ে পড়া শুরু করেন। সে সময়ে তার আগ্রহের বিষয় ছিল তাপগতিবিদ্যা, আপেক্ষিকতা এবং কোয়ান্টাম বলবিদ্যা।

তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান ও মহাকাশ বিজ্ঞানে পদচারণা: কেমব্রিজে আসার পরপরই হকিং মটর নিউরণ ডিজিজে আক্রান্ত হন। এ কারণে তার প্রায় সকল মাংসপেশী ধীরে ধীরে অবশ হয়ে আসে।  কেমব্রিজে প্রথম দুইবছর তার কাজ তেমন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ছিল না। কিন্তু,  রোগের প্রকোপ কিছুটা থামলে, হকিং তার সুপারভাইজার ডেনিশ উইলিয়াম শিয়ামার সাহায্য নিয়ে পিএইচডি অভিসন্দর্ভের কাজে এগিয়ে যান। পদার্থবিজ্ঞানে হকিংয়ের গবেষণালব্ধ দুইটি অবদান সবচেয়ে বেশি স্বীকৃত। প্রথম জীবনে সতীর্থ রজার পেনরোজের সঙ্গে মিলে সাধারণ আপেক্ষিকতায় সিংগুলারিটি সংক্রান্ত তত্ত্ব। প্রথম অনিশ্চয়তার তত্ত্বকে হকিং ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণ গহ্বর-এর ঘটনা দিগন্তে (ইভেন্ট হরাইজনে) প্রয়োগ করে দেখান যে, ব্ল্যাকহোল থেকে বিকিরিত হচ্ছে কণা প্রবাহ। এই বিকরণ এখন হকিং বিকিরণ নামে পরিচিত। তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান ও মহাকাশ বিজ্ঞানের জগত চষে বেড়িয়েছেন প্রায় ৪০ বছর। লিখিত পুস্তক এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে লেকচার দিয়ে হকিং একাডেমিক জগতেও যথেষ্ট খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। তত্ত্বীয় কসমোলজি আর কোয়ান্টাম মধ্যাকর্ষ হকিংয়ের প্রধান গবেষণাক্ষেত্র। প্রখ্যাত এই বিজ্ঞানী কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লুকাসিয়ান অধ্যাপক (স্যার আইজ্যাক নিউটনও একসময় এই পদে ছিলেন) হিসেবে ২০০৯ সালের ১লা অক্টোবর অবসর  নেন। এছাড়াও তিনি কেমব্রিজের গনভিলি এবং কেয়াস কলেজের  ফেলো হিসাবে কমরত ছিলেন।

১৯৮৫ সালে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসেন হকিং। ১৯৮৫ সালের গ্রীষ্মে জেনেভার ঈঊজঘ এ অবস্থানকালে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত  হয়েছিলেন তিনি।  চিকিৎসকরাও তার কষ্ট দেখে একসময় লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম বন্ধ করে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সমপ্রতি হকিংয়ের জীবন নিয়ে তৈরি হয়েছে এক তথ্যচিত্র। সেখানেই এই তথ্য জানিয়েছেন হকিং। তিনি বলেছেন, ‘নিউমোনিয়ার ধকল আমি সহ্য করতে পারিনি, কোমায় চলে গিয়েছিলাম। তবে চিকিৎসকরা শেষ অবধি  চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন, হাল ছাড়েননি।’ কিন্তু চেষ্টা সত্ত্বেও অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে চিকিৎসকরা হকিংয়ের স্ত্রী  জেনকেও লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম বন্ধ করে দেয়ার কথা জানান। তবে  সে প্রস্তাবে অবশ্য রাজি হননি জেন। পাঁচ দশক ধরে মোটর নিউরণের ব্যাধির শিকার জগৎখ্যাত এই পদার্থবিদ। বিশেষজ্ঞদের মত, এই রোগে আক্রান্তরা বড়জোর বছর পাঁচেক বাঁচেন। তথ্যচিত্রে তুলে ধরা হয়েছে  রোগের সঙ্গে হকিংয়ের লড়াইয়ের কাহিনী। বেঁচে থাকার জন্য হকিংয়ের আর্তিও ফিরে এসেছে বারবার।

গত দু’দশকের সঙ্গী জেন বলেছেন, ‘হকিংয়ের এই ব্যাধি আমাদের ব্যক্তিজীবনের ব্ল্যাকহোল। যে গহ্বরে বাঁচার আশা হয়ত তলিয়ে যেতে পারত অনেক আগেই। কিন্তু সম্পর্কে আস্থা আর পরস্পরের প্রতি অগাধ ভালোবাসা তলিয়ে যেতে দেয়নি।’ তথ্যচিত্রে কর্মজীবনের চেয়ে হকিংয়ের ব্যক্তিজীবনকে বেশি গুরুত্ব দেয়ায় বিজ্ঞানীদের একাংশ অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাদের দাবি, বিজ্ঞানে অবদান ছাড়া হকিংয়ের জীবনকে দেখানো মানে তাকেই গুরুত্বহীন করে তোলা। তবে তথ্যচিত্রে এমন কিছু তথ্যও পরিবেশিত হয়েছে, যা হকিংয়ের একটা অদেখা দিক আমাদের সামনে তুলে ধরে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status