বই থেকে নেয়া

উত্তম কুমারের অজানা কথা (৩৭)

‘আমাকে ঘিরে গৌরীর স্বপ্ন যেন সার্থকতার দ্বারপ্রান্তে’

৬ মার্চ ২০১৮, মঙ্গলবার, ৫:১৭ পূর্বাহ্ন

বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি মহানায়ক উত্তম কুমার অনন্য অভিনয় জাদুতে মুগ্ধতা বিলিয়েছেন দুর্নিবার। তার অভিনীত ছবি মানেই ভালোলাগার এক বিশাল প্রাপ্তি। পর্দায় এ নায়ক যেমন উজ্জ্বল তেমনই তার ব্যক্তিজীবনের চলাচলেও ছিল নানান রঙের মিশেল। সেই অজানা জীবনের গল্প তার বয়ান থেকে অনুলিখন করেছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক-সাহিত্যিক গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ যা পরবর্তী সময়ে ‘আমার আমি’ নামে বই আকারে প্রকাশ হয়। সে বই থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে উত্তম কুমারের আত্মজীবনী-

মনে আছে ১৯৪৬ সালে যখন আমি ‘ওরে যাত্রী’ ছবিতে শুটিং করছিলাম তখন ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে অন্য একটি ফ্লোরে দেবুবাবুর সঙ্গে আমার প্রথম চাক্ষুষ দেখা। আলাপ তখনও হয়নি। আমার সঙ্গে আলাপ না হতেই, আমার একটা সেটে একটু অভিনয় দেখে সেদিনকার দেবনারায়ণ গুপ্ত যে উক্তি করেছিলেন তা কোনোদিনই বিস্মৃত হব না। রাজেনবাবু জিজ্ঞাসা করেছিলেন দেবুদাকে, কেমন লাগল?
সঙ্গে সঙ্গে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, বেশ ভালো লাগল ভদ্রলোকের অভিনয়, দুর্গাদাসের পর মনে হলো ইনি দ্বিতীয় নায়ক। টিকে থাকলে বাংলাদেশের ছবির জগতে নায়কের অভাব ইনিই পূরণ করতে পারবেন।
সেই দেবনারায়ণ গুপ্তের নাট্যরূপায়িত শ্যামলীতে আমার ডাক এল।
নাট্যরূপ দেওয়া শেষ হলে শুরু হলো নাটকের চরিত্র বণ্টন। নায়ক আর নায়িকা হিসাবে কাদের নেওয়া হবে তখন সেই ভাবনা যেন ওদের গ্রাস করেছে। ইতিমধ্যে সুলালদা মানে জহর গাঙ্গুলি স্টারে যোগ দিয়েছেন। জহর গাঙ্গুলির তখন নিদারুণ প্রতাপ। তার কোনো উপদেশ বা প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করার ক্ষমতা তখন অনেকেরই ছিল না। সেই জহর গাঙ্গুলিই একসময়ে স্টার থিয়েটারের কর্তৃপক্ষের কাছে আমার নামটা প্রস্তাব করেছিলেন। সুলালদার প্রস্তাবই তৎক্ষণাৎ মেনে নিয়েছিলেন তারা। তবে সিনেমার সঙ্গে যে নায়ক জড়িত সেই নায়ক এসে মঞ্চের অভিনয় কতটুকু ফুটিয়ে তুলতে পারবে তাই নিয়ে তখনও তাদের সংশয়। তবুও ওরা আমাকে মঞ্চে অভিনয় করার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। আমি স্বতস্ফূর্তভাবে রাজি হয়ে গেলাম। যথাসময়ে হাজির হলাম স্টার থিয়েটারে।
রিহার্সাল শুরু হলো। এ-কথা স্বীকার করতে আজ আমি গর্ববোধ করি যে, রিহার্সাল চলাকালীন আমি একদিনের জন্যও কাজে গাফিলতি দেখাইনি। যথাসময়ে হাজিরা দিতাম রিহার্সালে। প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে আমি চরিত্রটি ভালো করে বুঝে নিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করিনি। পরিচালকের নির্দেশ যেখানে মনে ধরেনি, সেখানে সেই মুহুর্তে আমি চুপিচুপি দেবুদার কাছে আমার সাজেশন পেশ করেছি। নিজেকে ঝালাই করে নিয়েছি। পরিচালক যখন যেভাবে আমাকে দিয়ে অভিনয় করিয়েছেন তখনই ঠিক সেইভাবে তাকে আমি ফলো করেছি। এতটুকুও ক্লান্তি বোধ করিনি। অবশেষে ‘শ্যামলী’র অনিল আমার ধ্যানজ্ঞান হয়ে দাঁড়াল।
১৯৫৩ সালের ১৫ই অক্টোবর স্টারে ‘শ্যামলী’ মঞ্চস্থ হলো।
বাবা-মাকে প্রণাম করে আমি পাদপ্রদীপের সামনে এসে দাঁড়ালাম। অভিনয় করলাম। এক এক রাতের অভিনয় শেষ হয়, আর সকলেই কেন জানিনে আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন। অনেকেই আমার অভিনয় শেষে মেকআপ রুমে আসেন আমাকে অভিনন্দন জানাতে।
আমার খুশির মাত্রা দিন দিন বেড়ে চলল।
ওদিকে তখন পর-পর অনেকগুলো ছবিতেই আমি অভিনয় করে চলেছি। অনেকগুলো ছবির ব্যাপারে চুক্তিপত্রে সইও করেছি। চিত্রজগতের অনেকেই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই আমাকে তাদের ছবির জন্য নির্বাচিত করেছেন।
এইসব ছবির মধ্যে সুকুমার দাশগুপ্তের ‘ওরা থাকে ওধারে’ এবং ‘সদানন্দের মেলা’, নরেশ মিত্রর ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’, নিউ থিয়েটার্সের ‘বকুল’, ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘চাঁপাডাঙ্গার বৌ’, ‘কল্যাণী’, ‘গৃহপ্রবেশ’, ‘মন্ত্রশক্তি’, ‘মনের ময়ুর’। একদিকে পাদপ্রদীপের সামনে সপ্তাহে তিনদিনের চারটি শো ও অন্য ছুটির দিনে ‘শ্যামলী’র বিশেষ শো-তে দর্শকদের অভিবাদন জানানো, অন্যদিকে কলকাতার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ছুটে বেড়ানোর মধ্যে আমি যেন নতুন করে বাচার আনন্দ উপভোগ করছি।
অল্পদিনের মধ্যে ‘শ্যামলী’ রীতিমতো জমে উঠল। প্রত্যেকটি দর্শকের মুখে বোবা ‘শ্যামলী’র ভূয়সী প্রশংসা, অন্যদিকে অনিলের খ্যাতি। বলা প্রয়োজন, শ্যামলীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়।
পত্র-পত্রিকা ‘শ্যামলী’র সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠল। থিয়েটারের ক্ষেত্রে এবার খবরের কাগজের সমালোচনা স্তম্ভ আমাকে হাতড়ে বেড়াতে হলো না।
মনে পড়ছে আর স্মৃতির পৃষ্ঠাগুলো এক এক করে সরে যাচ্ছে। মনে পড়ছে ৩০/১০/৫৩ তারিখের কথা। কে যেন খানকতক খবরের কাগজ নিয়ে আমার সামনে এসে হাজির। কাগজগুলো আমাকে দিয়ে বলেছিল, দেখো। আমি দেখেছিলাম আনন্দবাজার তার নিরপেক্ষ মন্তব্য পেশ করেছেÑ
অনিলের ভূমিকায় উত্তমকুমার পর্দার চেয়ে মঞ্চের অভিনয়েই বেশি কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। নাটকখানি জমে ওঠায় তার অভিনয় অনেকখানি সাহায্য করেছেÑ
সেই একই তারিখের স্টেটসম্যান পত্রিকা মেলে ধরলাম চোখের সামনে- Young and personable Uttam Kumar, Alredy a film favourite, is a delightful (if at times overimpulsive) answer to the producer's problem of jvuenile leads for the stage. He should soon learn the exberance and effectiveness are not necessarily in direct ratio.
স্টার থিয়েটারের জনসমাগম উত্তরোত্তর বাড়তে থাকল। আজ ভাবলেও আনন্দ লাগে, স্টার থিয়েটার আমার নাম প্রচার ইস্তাহারে দিয়েছিলেন এই রকম- অনিলের ভূমিকায় উত্তমকুমার (ফিল্ম)।
শ্যামলীর জনপ্রিয়তা যত শিখরে পৌঁছতে থাকে, পত্র-পত্রিকাও তত মুখর হতে থাকে। ৬/১১/৫৩ তারিখে যুগান্তরে সমালোচনা-স্তম্ভে বেরিয়েছিলÑ
‘ভাবপ্রবণ অভিনয়ে নায়কের ভূমিকায় উত্তমকুমার সকল কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন এবং মঞ্চাভিনেতারূপে তার আবির্ভাবকে সার্থক করে তুলেছেন...’
এমনি করে একরাশ সাফল্যের আনন্দে আমার মন ভরে উঠল। আমাদের সেই পঙ্গু সংসারটা তখন অনেকখানি সুস্থ হয়ে উঠেছে। আমাকে ঘিরে গৌরীর স্বপ্ন যেন সার্থকতার দ্বারপ্রান্তে। আমার ব্যস্ততার জন্য ‘শ্যামলী’ থেকে কিছুদিনের জন্য অবসর নিলাম। অঙ্গীকার করে এলাম আবার ফিরে আসব স্টারে, ‘শ্যামলী’র জন্য।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status