প্রথম পাতা

দুর্নীতি সূচকে বাংলাদেশের উন্নতি

স্টাফ রিপোর্টার

২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, শুক্রবার, ৯:৫৭ পূর্বাহ্ন

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতিবিরোধী ধারণা সূচকে কিছুটা   উন্নতি হয়েছে বাংলাদেশের অবস্থানের। ২০১৭ সালে ১৮০টি দেশের ওপর চালানো জরিপে বাংলাদেশের স্থান ১৭তম। আগের বছর ২০১৬ সালে ১৭৬টি দেশের ওপর চালানো জরিপে ওই অবস্থান ছিল ১৫তম। অবশ্য স্কোরেও কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। আগের বছরের তুলনায় স্কোর ২ বেড়ে এখন ২৮। ২০১৬ সালে তা ছিল ২৬। তবে ১০০ স্কোরের মধ্যে ৪৩ কে গড় স্কোর হিসেবে বিবেচনায় বাংলাদেশের ২০১৭ সালের স্কোর ২৮ হওয়ায় দুর্নীতির ব্যাপকতা এখনো উদ্বেগজনক বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ পঞ্চমবারের মতো দ্বিতীয় শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের অবস্থানে রয়েছে।   

রাজধানীর মাইডাস সেন্টারে গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে দুর্নীতির ধারণা সূচক ২০১৭ উপস্থাপনকালে এসব তথ্য তুলে ধরেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, ধারণাসূচকে বাংলাদেশ হয়তো দুই ধাপ এগিয়েছে, কিন্তু তা মোটা দাগে আশার সঞ্চার করে না। কারণ, দক্ষিণ এশিয়ায় কেবল আফগানিস্তানের চেয়ে আমরা এগিয়ে আছি। আর এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলেও নিচের দিক থেকে আমাদের অবস্থান চতুর্থ। অন্যদিকে আমাদের এগিয়ে যাওয়া কিছুটা ঊর্ধ্বগামী হলেও সেটা স্থায়িত্বশীল ও দ্রুত নয়।

দুর্নীতি মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাজার রায় সূচকের অগ্রগতিতে ভূমিকা রেখেছে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সূচক তৈরি হয়েছে মামলার রায়ের আগের তথ্য নিয়ে। এতে কোনো প্রভাব পড়ে কি না তা পরের বার দেখা যাবে। তবে এখন আমরা যদি বলি, সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে বিচারের আওতায় আনার মাধ্যমে বাংলাদেশে আইনের চোখে সবাই সমান হয়ে গেছে, তা কিন্তু নয়। এর ধারাবাহিকতা যদি না রাখতে পারি অন্য সবক্ষেত্রে, তাহলে দুর্নীতি ও এর বিচার নিয়ে জনমনে প্রশ্ন থেকেই যাবে।

টিআইবির বিভিন্ন জরিপ পর্যবেক্ষণ ও ফলাফলের ভিত্তিতে তৈরি দুর্নীতির এই ধারণা সূচকে ঊর্ধ্বক্রম অনুযায়ী (ভালো থেকে খারাপ) ১৮০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান এবার ১৪৩ নম্বরে। গতবার ১৭৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪৫ নম্বরে। আবার নিম্নক্রম অনুযায়ী (খারাপ থেকে ভালো) বাংলাদেশ আগের ১৫তম অবস্থান থেকে দুই ধাপ এগিয়ে এবার ১৭তম স্থানে উঠে আসে। পাশাপাশি ১০০ স্কোরের মধ্যে এই সূচকে বাংলাদেশের  স্কোর এবার ২ পয়েন্ট বেড়ে ২৮ হয়েছে। এই স্কেলে শূন্য স্কোরকে দুর্নীতির ব্যাপকতার ধারণায় সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত এবং ১০০ স্কোরকে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত বা সর্বোচ্চ সুশাসনের দেশ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। প্রতিবেদন অনুযায়ী তালিকায় এবারও সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে আফ্রিকার দেশ সোমালিয়া। দেশটির স্কোর গতবারের চেয়ে ১ পয়েন্ট কমে হয়েছে ৯। এরপরে রয়েছে যথাক্রমে সাউথ সুদান, সিরিয়া, আফগানিস্তান, ইয়েমেন, সুদান, লিবিয়া, উত্তর কোরিয়া, গিনিবিসাউ, ইকুয়েটোরিয়াল গিনি, ভেনেজুয়েলা ও ইরাক। এর বিপরীতে সর্বোচ্চ ৮৯ স্কোর নিয়ে তালিকায় সবচেয়ে কম দুর্নীতির দেশ নিউজিল্যান্ড। এরপর কম দুর্নীতি প্রবণ দেশের তালিকায় রয়েছে ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, সুইডেন, কানাডা, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস ও  যুক্তরাজ্য।

আর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সূচকে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে ভুটান। ৬৭ স্কোর নিয়ে ভুটানের অবস্থান সূচকের ঊর্ধ্বক্রম অনুযায়ী ২৬ নম্বরে। এরপর ৪০ স্কোর নিয়ে ভারত ৮১তম, ৩৮ স্কোর নিয়ে শ্রীলঙ্কা ৯১তম, ৩৩ স্কোর নিয়ে মালদ্বীপ ১১২তম, ৩২ স্কোর নিয়ে পাকিস্তান ১১৭তম, ৩১ স্কোর নিয়ে নেপাল ১২২তম এবং ১৫ স্কোর নিয়ে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ আফগানিস্তান রয়েছে ১৭৭তম স্থানে। আর ২৮ স্কোরে বাংলাদেশের সঙ্গে একই অবস্থানের রয়েছে গুয়েতেমালা, কেনিয়া, লেবানন ও মৌরিতানিয়া।
ধারণাসূচক উপস্থাপনকালে টিআইবির নির্বাহী ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আইনি, প্রাতিষ্ঠানিক ও নীতি কাঠামোতে তুলনামূলকভাবে সুদৃঢ় অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ এবার সূচকে সামান্য এগিয়েছে। ই-প্রকিউরমেন্টসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ডিজিটাইজেশনও এক্ষেত্রে ফল দিয়েছে। কিন্তু সেই নীতি প্রয়োগে ঘাটতি, ব্যাংকিং ও অর্থনৈতিক খাতসহ বিভিন্ন খাতে ক্রমবর্ধমান অনৈতিক প্রভাব বিস্তার অনিয়ম ও দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলায় জড়িত ও সহায়তাকারীদের বিচারের আওতায় আনতে তথা জবাবদিহি নিশ্চিতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য না পাওয়ায় আমরা আরও ভালো করতে পারিনি। নির্বাচনী বছরে সূচকের এই অগ্রগতি কোনো প্রভাব ফেলবে কি না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্রভাব ফেলার বিষয় আমরা মাথায় রাখি না। নির্বাচনে এর সুফল আসে কি না সেটার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে, আমরা এই অগ্রগতিতে সন্তুষ্ট না। দক্ষিণ এশিয়ায় বিব্রতকরভাবে কেবল আফগানিস্তানের থেকে এগিয়ে রয়েছে। আর সবার পেছনে রয়েছে বাংলাদেশ। এই ধারণা সূচক তৈরি বা প্রণয়নে টিআইবির নিজস্ব কোনো জরিপ ভূমিকা রাখে না দাবি করে সংস্থাটির এই নির্বাহী বলেন, বিশ্বব্যাপী মোট ১৩টি প্রতিষ্ঠানের জরিপ ও গবেষণার ওপর ভিত্তি করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল এই সূচক প্রণয়ন করে।

টিআইবি আরো জানায়, ধারণা সূচক তৈরিতে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আটটি জরিপের সাহায্য নেওয়া হয়। তার মধ্যে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ‘এক্সিকিউটিভ ওপিনিয়ন সার্ভে’, ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ‘কান্ট্রি রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট’, ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্টের ‘রুল অব ল’ইনডেক্স’, পলিটিক্যাল রিস্ক সার্ভের ‘ইন্টারন্যাশনাল কান্ট্রি রিস্ক গাইড’, বার্টেলসম্যান ফাউন্ডেশনের ‘ট্রান্সফরমেশন ইনডেক্স’ এবং বিশ্ব ব্যাংকের ‘কান্ট্রি পলিসি অ্যান্ড ইনস্টিটিউশনাল অ্যাসেসমেন্টের’ তথ্য এক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে।
তিনি আরো বলেন, টিআই কর্তৃক ধারণা সূচক ২০১৭-এর ফলাফলে বিশ্বব্যাপী নাগরিক স্বাধীনতা সংকুচিত হওয়ার সঙ্গে দুর্নীতি বৃদ্ধি পাওয়ার নিবিড় সম্পর্ক দেখা যায়; যা বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। দুর্নীতি মোকাবিলায় মুক্ত ও সক্রিয় নাগরিক সমাজ, অবাধ গণমাধ্যম ও বেসরকারি সংস্থাসহ জনগণের জন্য সহায়ক ও অংশগ্রহণমূলক পরিবেশ তৈরি করতে হবে যেন অগ্রযাত্রায় কেউ বাদ না যায়। একইসঙ্গে টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা অর্জনে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সরকারকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোরালো রাজনৈতিক ভূমিকা গ্রহণের পাশাপাশি জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে যেকোনো ধরনের প্রভাবমুক্ত থেকে স্বাধীন ও কার্যকরভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে।

সংবাদ সম্মেলনে বৈশ্বিক দুর্নীতি পরিস্থিতির তথ্য তুলে ধরে জানানো হয়, ২০১৭ সালের দুর্নীতিবিরোধী ধারণা সূচক অনুযায়ী বৈশ্বিক দুর্নীতি পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক। সূচক অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে লক্ষণীয় উদ্যোগ গ্রহণের পরও অধিকাংশ দেশের প্রচেষ্ঠার ক্ষেত্রে ধীরগতি পরিলক্ষিত হয়েছে। দুই-তৃতীয়াংশের অধিক দেশ ৫০-এর নিচে স্কোর পেয়েছে। বিশ্লেষণে দেখা যায়, যেসব দেশে গণমাধ্যম ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ (এনজিও) কম সুরক্ষা পেয়ে থাকে, সেসব দেশে দুর্নীতি অধিকতর মাত্রায় বিদ্যমান।  

উল্লেখ্য, ধারণাপত্র অনুযায়ী ০ থেকে ১০০ স্কেল এর ‘০’ স্কোরকে দুর্নীতির কারণে সর্বোচ্চ ক্ষতিগ্রস্ত ও ‘১০০’ স্কোরকে দুর্নীতির কারণে সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত বা সর্বাধিক সুশাসিত বলে ধারণা করা হয়। যে দেশগুলো সূচকে অন্তর্ভুক্ত নয় তাদের সম্পর্কে এ সূচকে কোনো মন্তব্য করা যায় না। সূচকে অন্তর্ভুক্ত কোনো দেশই এখন পর্যন্ত শতভাগ স্কোর পায়নি। সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এম. হাফিজ উদ্দিন খানসহ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status