এক্সক্লুসিভ

ভাষা শহীদ রফিক স্মৃতি গ্রন্থাগারটি যেমন...

রিপন আনসারী, মানিকগঞ্জ থেকে

২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৮:১৪ পূর্বাহ্ন

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে রক্তাক্ত পথের প্রথম বলি হয়েছিলেন মানিকগঞ্জের অহংকার ভাষা শহীদ রফিক উদ্দিন আহমেদ। তার জন্ম জেলার সিংগাইর উপজেলার পারিল গ্রামে। সে গ্রামটি এখন শহীদ রফিক নগর হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
ভাষা শহীদ রফিকের স্মৃতিকে ধরে রাখতে ২০০৮ সালে জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে তার জন্মভূমি রফিক নগর এলাকায় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে গ্রন্থাগার ও জাদুঘর। এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়েছে ঠিকই কিন্তু গ্রন্থ্থাগার ও জাদুঘরের যা যা থাকার কথা তা নেই। যার ফলে শুধু নেই আর নেই উচ্চারণ ছাড়া সেখানে আর কিছুই নেই।
গ্রন্থাগার ও জাদুঘরের সামনে শহীদ রফিকের যে ছবির ম্যুরাল রয়েছে তার সঙ্গে রফিকের বাস্তবের ছবির কোনো মিল না থাকায় ক্ষোভ রয়েছে এলাকার মানুষের। ফলে দীর্ঘ ১০ বছর ধরে এই ম্যুরাল নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনার ঝড়।
শুধু শহীদ রফিকের ম্যুরালই নয় শহীদ রফিক গ্রন্থ্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরে রফিকের কোনো স্মৃতি সংরক্ষণে রাখা হয়নি। গ্রন্থাগারে শহীদ রফিকের জীবনী নিয়ে স্বল্প আকারের শুধুমাত্র একটি বই সংরক্ষণে রাখা হলেও অন্যান্য ভাষা শহীদকে নিয়ে লেখা কোনো বই সেখানে নেই। যার ফলে সেখানকার নতুন প্রজন্ম বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে তেমন অবগত হতে পারছে না বলেও অভিযোগ রয়েছে মানুষের ভেতর।
সরজমিন সিংগাইরের পারিল গ্রাম অর্থাৎ রফিক নগরে প্রতিষ্ঠিত ভাষা শহীদ রফিক গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরে গিয়ে দেখা যায়, ছোট ছোট শিশু-কিশোরদের কোলাহল। কেউ বই পড়ছে কেউ পত্রিকা আবার কেউ গল্প গুজব করে সময় কাটাচ্ছে। ছোটদের পাশিপাশি দূরদূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরাও ছুটে আসছেন রফিক নগরের এই ছোট্ট গাঁয়ে। মায়ের ভাষার জন্য যিনি আত্মাহুতি দিয়ে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করেছেন সেই শহীদ রফিকের জন্মভূমির ধুলো মাটিতে পা রাখতে পেরে অনেককেই ধন্য হয়ে যায়। অনুভূতি ব্যক্ত করেন ভিন্ন ভিন্নভাবে। তবে যত তর্কবির্তক চলে শহীদ রফিকের ম্যুরাল নিয়ে। এ নিয়ে সর্বক্ষণ সরগরম থাকে গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরে আসা দর্শনার্থীদের ভেতর। শহীদ রফিকের এই ম্যুরাল নিয়ে আলোচনা অল্প কিছু দিনের নয়, দীর্ঘ ১০ বছর ধরেই চলছে আলোচনার ঝড়। কর্তৃপক্ষ অবগত থাকলেও সমাধানের বাণী শোনা যাচ্ছে কয়েক বছর ধরেই। একুশ ফেব্রুয়ারি এলেই ম্যুরালের বিষয়টি উঠে আসে মিডিয়ার মফস্বল পাতার শিরোনামে। তখন কর্তাব্যক্তিরা বেশ জোরালোভাবেই শহীদ রফিকের সঠিক ছবির ম্যুরাল প্রতিস্থাপন করার কথা বলেন। কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারি চলে গেলে সব কথাই হারিয়ে যায়। শুধু শহীদ রফিকের ম্যুরাল নিয়ে আলোচনা থেমে নেই। সমালোচনা চলে গ্রন্থাগারে ভাষা শহীদদের ওপর লেখা বই না থাকা এবং জাদুঘরে শহীদ রফিকের কোনো স্মৃতি সংরক্ষণ না থাকায়।
সেখানে গিয়ে কথা হয় নানা বয়সী এবং নানা পেশার মানুষের সঙ্গে। ঢাকার বসুন্ধরা এলাকা থেকে ঘুরতে আসেন ওয়াসিম আহমেদ ও তার পরিবারের ৪ সদস্য। ওয়াসিম জানালেন, আমি সুযোগ পেলেই পরিবার নিয়ে ছুটে আসি শহীদ রফিক নগরে। এসেই ছুটে যাই ভাষা শহীদ রফিক গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরে। তবে কষ্ট হয় একজন ভাষা শহীদের ছবি ম্যুরালের সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল না থাকায়। যারা এই ছবিটা লাগিয়েছেন তারা কেনো এর গুরুত্ব বুঝলো না। এত বছর হয়ে গেল তারপরও আসল ছবির ম্যুরাল স্থাপন না করায় শহীদ রফিককে অবমাননা করা হচ্ছে বলে আমি মনে করি।
আতাউর রহমান তোহা নামের এক সাবেক ছাত্রনেতা জানালেন, শহীদ রফিকের জেলায় জন্ম নিয়ে আমি গর্বিত। দেশের যে প্রান্তেই যাই সেখানে গর্ব করে বলতে পারি আমি শহীদ রফিকের জেলার মানুষ। দুঃখের বিষয় হচ্ছে শহীদ রফিক গ্রন্থাগারে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের ওপর কোনো বই নেই। এছাড়া নামেই জাদুঘর, সেখানে ভাষা শহীদ রফিকের যেসব স্মৃতি রয়েছে তার কোনোটিও সংরক্ষণে রাখা হয়নি। শুনেছি শহীদ পরিবারের কাছে শহীদ রফিকের হাতে বুনানো রুমাল, কলম, ম্যাট্রিকের সনদ, নকশি কাঁথা রয়েছে। সেগুলো যদি জাদুঘরে সংরক্ষণে রাখা হতো তাহলে নতুন প্র্রজন্ম সেগুলো দেখতে পারতো।
রফিক নগর এলাকার শিক্ষার্থী মামুন জানালেন, ভাষা শহীদ রফিক আমাদের গ্রামের অহংকার। যাকে নিয়ে আমরা জন্মজন্মান্তর গর্ব করবো। সেই অহংকারের ধন শহীদ রফিকের যে ম্যুরাল গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরের সামনে স্থাপন করা হয়েছে সেটা বাস্তাবের সঙ্গে কোনো মিল নেই বলে আমরা এলাকার মুরব্বিদের কাছে শুনেছি। এত বড় একজন মহান মানুষের ছবি নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে না। আমরা চাই দ্রুত শহীদ রফিকের প্রকৃত ছবি ম্যুরাল জাদুঘরের সামনে স্থাপন করা হোক।
শহীদ রফিক গ্রন্থাগারের লাইব্রেরিয়ান ফরহাদ জানান, এই গ্রন্থাগারে সাড়ে ১১ হাজার বই রয়েছে। এখানে শহীদ রফিকের অল্প কিছু জীবনী নিয়ে শুধুমাত্র একটি বই আছে। তবে ভাষা শহীদদের ওপর লেখা বই নেই। শহীদদের নিয়ে গবেষণাকেন্দ্রিক বইগুলো থাকলে নতুন প্রজন্ম জানতে পারতো ভাষা আন্দোলনের প্রকৃত ইতিহাস। প্রতিদিনই শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ পাঠাগারে এসে জানতে চায় ভাষা শহীদদের ওপর লেখা বই কেন সংরক্ষণে আনা হচ্ছে না। আমরা কোনো উত্তর দিতে পারি না। কর্তৃপক্ষকে অসংখ্যবার বলা সত্ত্বেও কোনো কাজে আসছে না।
মানিকগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোটেক গোলাম মহীউদ্দিন বলেন, ভাষা শহীদ রফিক উদ্দিন আহমেদের যে ছবি গ্রন্থাগারের সামনে ম্যুরাল আকারে স্থাপন করা হয়েছে তার সঙ্গে বাস্তবের রফিকের মিল নেই এটা প্রমাণিত। তাই আমরা জেলা পরিষদের মাধ্যমে বাস্তবসম্মত ম্যুরাল স্থানের ব্যবস্থা দ্রুত করবো। যাতে এ নিয়ে আর কোনো বিতর্ক না থাকে। এছাড়া শহীদ রফিকের স্মৃতি হিসেবে নকশিকাঁথার রুমাল, ম্যাট্রিকের সনদ, কলমসহ আরো যা আছে সেগুলো শহীদ রফিকের পরিবারের ছোট ভাইয়ের কাছে রয়েছে বলে আমাকে জানানো হয়েছে। পরিবারের সঙ্গে কথা বলে সেই স্মৃতিগুলো গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরে রাখার কাজটিও আমরা করবো। এদিকে শহীদ রফিকের পৈতৃক ভিটায় বসবাস করছেন শহীদ রফিকের ভাবী গুলেনার বেগম। বয়সের ভারে তিনি এখন ভালোমতো চলাফেরা করতে পারেন না। তবে আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ফেব্রুয়ারি মাস এলেই আমাদের কথা সবার মনে পড়ে। বছরের বাকিটা সময় কেউ খোঁজও নেয় না।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status