শেষের পাতা

ফোর-জি’র যুগে বাংলাদেশ

কাজী সোহাগ

২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:২০ পূর্বাহ্ন

চতুর্থ প্রজন্মের (ফোর-জি) টেলিযোগাযোগ যুগে এখন বাংলাদেশ। গতকাল রাত ৮টা থেকে ফোর-জি সেবা পাচ্ছেন তিন বেসরকারি অপারেটরের গ্রাহকরা। সন্ধ্যায় রাজধানীর স্থানীয় এক ক্লাবে অপারেটরদের হাতে ফোর-জি’র লাইসেন্স তুলে দেয়া হয়। এর পরপরই অপারেটররা সেবাটি চালু করেন। এর আগে ফোর-জি’র জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রাখে তারা। অবশ্য বিকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফোর-জি সেবা চালুর সুখবরটি দেন দেশবাসীকে। লাইসেন্স দেয়ার অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। লাইসেন্স তুলে দেন বিটিআরসি চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদ। স্পেকট্রাম নিলামের পরই অপারেটররা ঘোষণা দিয়ে আসছেন সেবাটি চালু করতে। এ নিয়ে অপারেটরদের মধ্যে নানা ধরনের প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যায়। কে কার আগে ফোর-জি নিয়ে গ্রাহকদের কাছে যাবেন তা নিয়ে রীতিমতো যুদ্ধে নামেন তারা। অপারেটরদের এ ধরনের প্রতিযোগিতাকে ইতিবাচক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে ফোর-জি সেবা কতজন পাবেন, তা নিয়ে এখনই জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে গেছে। এই আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে হ্যান্ডসেটের ধারণ ক্ষমতা। ফোর-জি নেটওয়ার্কের মাঝে বেশ কিছু ধরন ও সংস্করণে পার্থক্য রয়েছে। আর এর ফলে ফোন ফোর-জি সমর্থিত হলেও অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহারকারীরা বাংলাদেশে ফোর-জি ব্যবহার করতে পারবেন না। বাংলাদেশে ৯০০, ১৮০০ ও ২১০০ মেগাহার্টজ ফ্রিকোয়েন্সিতেই ফোর-জি সেবা দেবে অপারেটররা। বাংলাদেশে এখন যে সব মোবাইল ফোন ব্যবহার হচ্ছে, তার মাত্র ১০ থেকে ১৫ ভাগ ফোর-জি সমর্থিত। অর্থাৎ ৮৫ থেকে ৯০ ভাগ মোবাইল গ্রাহক ফোর-জি সেবা থেকে বঞ্চিত হবেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ মোবাইলফোন ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমপিআইএ) সভাপতি রুহুল আলম আল মাহবুব বলেন, দেশে বর্তমানে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি গ্রাহক স্মার্টফোন ব্যবহার করছেন। এর মধ্যে মাত্র ১০ ভাগ ফোন ফোর-জি’র ফ্রিকোয়েন্সি ধারণ করতে সক্ষম। তবে মোবাইলফোন আমদানিকারকরা জানিয়েছেন, বাজারে এখন ১০ হাজার টাকার ওপরে যেসব স্মার্টফোন পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলোর সবই ফোর-জি সমর্থিত। হ্যান্ডসেট আমদানিকারকরা বলছেন, সব মিলে এখন ৪৫ লাখের মতো মানুষের কাছে ফোর-জি সমর্থিত স্মার্টফোন রয়েছে। দেশে গ্রামীণফোনের সাড়ে ৬ কোটি, রবির ৪ কোটি ২০ লাখ, বাংলালিংকের ৩ কোটি ২০ লাখ এবং টেলিটকের ৪৪ লাখ গ্রাহক রয়েছে। গ্রামীণফোন জানিয়েছে, তাদের ১৪ শতাংশ গ্রাহকের হাতে ফোর-জি হ্যান্ডসেট রয়েছে। যদিও তারা ইতিমধ্যে ১ কোটি গ্রাহককে ফোর-জি সিম দিয়েছে। এদিকে তিন অপারেটর গতকাল থেকে ফোর-জি সেবা চালু করলেও টেলিটক করতে পারেনি। গতকাল  ফোর-জি লাইসেন্স নিলেও সেবাটি চালু করতে তাদের দেরি হবে। কিন্তু কত দেরি হবে, সে বিষয়ে স্পষ্ট করে দায়িত্বশীল কেউ মন্তব্য করতে রাজি হননি। ২০১২ সালে দেশে থ্রি-জি’র মাধ্যমে দ্রুতগতির মোবাইল ইন্টারনেট চালু হয়। ফোর-জি’র মাধ্যমে সেই ইন্টারনেটের গতি আরো বাড়বে। সংশ্লিষ্টরা জানান, অবকাঠামোগত দুর্বলতা নিয়ে দেশে ফোর-জি চালু হচ্ছে। ফলে দেশে কতটা ভালো মানের ফোর-জি সেবা দেয়া যাবে, তা নিয়ে সংশয় আছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, দ্রুতগতির ফোর-জি সেবা পেতে হলে নেটওয়ার্কের পাশাপাশি শক্তিশালী ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক অবকাঠামো দরকার। সেটি দেশে নেই। বিটিআরসির অবকাঠামো ভাগাভাগি নীতিমালা অনুযায়ী এনটিটিএন (নেশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক) অপারেটর ছাড়া আর কোনো প্রতিষ্ঠান সারা দেশে ফাইবার অপটিক ভাগাভাগি করে ব্যবহার করতে পারে না। এনটিটিএন অপারেটররা দাবি করেছে, দ্রুতগতির ফোর-জি সেবার জন্য যে মানের ফাইবার অপটিক অবকাঠামো থাকা প্রয়োজন, তা দেশের উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত আছে। সারা দেশে বর্তমানে দুই বেসরকারি এনটিটিএনের ৬০ হাজার কিলোমিটারের বেশি ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক রয়েছে। মোবাইল অপারেটরদের উপজেলা পর্যন্ত দ্রুতগতির ট্রান্সমিশন সেবা দিতে এনটিটিএন অপারেটররা সম্পূর্ণ প্রস্তুত। ফোর-জি সেবা পেতে হলে সিম কার্ড ও হ্যান্ডসেটটি এ প্রযুক্তির উপযোগী হতে হবে। সিমটি ফোর-জি কিনা, সেটি বিনামূল্যে জানার সুযোগ আছে। গ্রামীণফোন ব্যবহারকারীরা মোবাইলফোন থেকে *১২১*৩২৩২# ডায়াল করলেই ফিরতি বার্তায় সিমটি ফোর-জি কিনা, তা জানতে পারবেন। রবির গ্রাহকদের এ জন্য ডায়াল করতে হবে *১২৩*৪৪ #। আর বাংলালিংকের গ্রাহকরা মোবাইল ফোন থেকে ৪এ লিখে ৫০০০ নম্বরে খুদে বার্তা পাঠালে ফিরতি বার্তায় ফোর-জি সিমের বিষয়ে তথ্য পাবেন। টেলিটক তাদের ব্যবহারকারীদের জন্য এখনো এ ধরনের কোনো সেবা চালু করেনি। ফোর-জি সেবা প্রসঙ্গে গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মাইকেল ফোলি বলেন, এর মাধ্যমে গ্রাহকদের নতুন পথে চলা শুরু হবে। রবি আজিয়াটার সিইও ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহতাব উদ্দিন আহমেদ জানান, প্রথম দিন থেকে সবচেয়ে বড় পরিসরে ফোর-জি নেটওয়ার্ক দেয়ার চেষ্টা করছে। বাংলালিংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এরিক অস বলেন, ফোর-জি অগণিত সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে বাংলাদেশকে ডিজিটাল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। বাংলাদেশে যাত্রা শুরুর পর থেকেই বাংলালিংক প্রযুক্তির মাধ্যমে জীবনযাত্রার গুণগত পরিবর্তন আনতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। এদিকে দেশে ফোর-জি নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন টেলিকম নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা সিনিয়র রিপোর্টার মুহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম (সজল)। গতকাল তার প্রকাশিত এক লেখায় তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ফোর-জি কি জীবনের গতি বাড়াবে? আমার শুধু প্রশ্ন ফোর-জি দিয়ে আমরা কী করব? ফোর-জি কী আমাদের জীবনের গতি বাড়াবে নাকি শুধু ইউটিউব দেখা বা বিদেশি মুভি দেখার জন্য খরচ হবে আমাদের হাজার হাজার কোটি টাকার এই অবকাঠামো? তিনি বলেন, দেশে ই-কমার্স এখনো সেভাবে জনপ্রিয় হয়নি, আশা করি সেটা হবে। এখানে ফাইন্যান্সিয়াল খাতের ডিজিটাইজেশন মানেই হলো কেবল এটিএম থেকে টাকা তোলা আর মোবাইলফোন থেকে গৃহকর্মীর বেতন বাড়িতে পাঠানো। অনলাইনে যে গেম খেলি তার কয়টাই বা দেশি? ই-শিক্ষা বা ই-স্বাস্থ্য সেবার কথা আসছে, কিন্তু সেটার জন্যই কী আমরা তৈরি? তাহলে কী করব আরেকটা “জি” বাড়িয়ে? আমাদের সরকার বা নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো কী সুযোগ দেবে ডিজিটাল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের? মোবাইল ফোনের গ্রাহক কী তার ডিভাইসটি দিয়েই সিনেমার টিকিট নিতে পারবেন বা রেস্টুরেন্টের রিজার্ভেশন নিশ্চিত করতে পারবেন? বন্ধ থাকা নানা দরজা কী খুলবে? বিদ্যুৎ-পানির বিল পরিশোধকেই তো আমরা ডিজিটালাইজ করতে পারলাম না- এত দাবি করি কি করে?
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status