শেষের পাতা

অমর একুশে গ্রন্থমেলা

সৃজনশীল বইয়ের পাশাপাশি ইতিহাস-ঐতিহ্যের বিপুল তথ্য ভাণ্ডার

মুনির হোসেন

১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, সোমবার, ১০:১৯ পূর্বাহ্ন

সৃজনশীল সব বইয়ের ভিড়ে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় আসা দর্শনার্থীদের ভিন্ন আমেজ দেয় বাংলা একাডেমিতে থাকা তিনটি জাদুঘরের স্টল। এসব স্টলে প্রদর্শিত হচ্ছে বাংলার প্রাচীন ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সাবেকি আমলের তথ্য-উপাত্ত ভিত্তিক নানা সংগ্রহ। এ ছাড়াও মহান মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের  স্মৃতিবিজড়িত বিভিন্ন স্মারক ও চিত্রকর্ম। মেলায় আসা দর্শনার্থীদের থেকে তরুণ ও মাঝ বয়সীরাই এসব স্টলে বেশি আসেন। দেখেন ও কিনে নেন  পছন্দের সব স্মারক। স্টলগুলোতে থাকা বিক্রয়কর্মীরা দর্শনার্থীদের ধারণা দেয় এসব স্টলের সংগ্রহে থাকা বিভিন্ন স্মারক সম্পর্কে। তিনটি স্টল হলো- জাতীয় জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘরের স্টল। স্টলগুলোতে বাংলাদেশের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি-মুক্তিযুদ্ধের নানা স্মৃতি, যুদ্ধকালীন প্রকাশিত বিভিন্ন পোস্টকার্ড, ভিউকার্ড, পোস্টার, দেয়ালিকা ও বিভিন্ন দুর্লভ চিত্রসম্বলিত অ্যালবাম প্রদর্শনীও বিক্রির জন্য রাখা হয়েছে।
জানতে চাইলে জাতীয় জাদুঘরের প্রদর্শক প্রভাষক মু. মুহসীন সরকার বলেন, ‘আমরা মূলত দর্শনার্থীদের জাতীয় জাদুঘরের কী ধরনের জিনিস রয়েছে সেগুলো সম্পর্কে ধারণা দেয়া ও জাদুঘর পরিদর্শনে আগ্রহী করতেই এখানে এসেছি। আমাদের স্টলে বাংলাদেশের বিভিন্ন জনগোষ্ঠী, স্থান ও সেখানকার ইতিহাস সম্বলিত নানা ধরনের গ্রন্থ পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়াও আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা এখানে বিক্রি হচ্ছে। শিশুদের উপযোগী চিত্রকর্ম প্রদশর্নীও বিক্রি হচ্ছে। আমাদের ঐহিহ্যের অংশ যেসব বিষয় সেগুলোর ভিউকার্ড, পোস্টার, চিত্রকর্ম, দেয়ালিকাসহ বিভিন্ন গবেষণা গ্রন্থের বাংলা ও ইংরেজি ভার্সন এখানে স্বল্প মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। মূলত আমরা দর্শনার্থীদের আগ্রহী করতেই এখানে বসেছি।’
পাশে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের স্টলকে সাজানো হয়েছে দুই ভাগে। একপাশে দর্শনার্থীদের জন্য প্রদর্শনী ব্যবস্থা, অন্যপাশে বিক্রি উপযোগী বিভিন্ন প্রকাশনা ও স্মারক। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন পোস্টকার্ড, স্যুভেনির, অ্যালবাম, ডকুমেন্টারির সিডিসহ নানা কিছু। এ ছাড়াও ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্র মালা’ নামে একটি অ্যালবাম ১ হাজার টাকার বিনিময়ে পাওয়া যাচ্ছে এখানে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের স্মারক সংগ্রাহক হারেছুজ্জামান বলেন, ‘আমরা স্টলের এক পাশে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত রেখেছি। তারা ভিতরে ঢুকেই মুক্তিযুদ্ধের দুর্লভ সব পোস্টার দেখতে পাচ্ছে। নতুন প্রজন্ম এগুলো দেখছে এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হচ্ছে।’ এরপরই দেখা মিলবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘরের। এখানেও মুক্তিযুদ্ধ ও এর আগে পরের বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন স্থিরচিত্র প্রদর্শিত হচ্ছে। আছে বঙ্গবন্ধু পরিবারের বিভিন্ন ছবি। পোস্টার আকারে দর্শনার্থীদের জন্য এগুলো রাখা আছে। চাইলে স্বল্প মূল্যে দর্শনার্থীরা এগুলো কিনতে পারে। এ ছাড়াও বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে নিয়ে বরেণ্য সব লেখকের বই এখানে বিক্রি হচ্ছে। আছে বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচাও। আছে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের করা ডকুমেন্টারি। এ ছাড়াও বঙ্গবন্ধুর ছবিসম্বলিত মগ ও প্লেট বিক্রি হচ্ছে এখানে। জাদুঘরের ভিজিটর গাইড বরুণ রাহা বলেন, ‘দর্শনার্থীরা এখানে আসছেন। তারা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানছেন, এবং নিজেদের সংগ্রহে রাখতে বিভিন্ন স্মারক সংগ্রহ করছেন।’
জাতীয় জাদুঘর থেকে একটি সিডি ও ভিউকার্ড কিনায় ব্যস্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্রী কামরুন নাহার বলেন, গ্রন্থমেলায় সৃজনশীল বইগুলোর পাশাপাশি আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্যের প্রদর্শনী নিশ্চিতভাবে ইতিবাচক দিক। এর মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম আমাদের গৌরবের সব বিষয় সম্পর্কে জানতে পারছে। এগুলো দেখে অনুপ্রাণিত হচ্ছে। তিনি বলেন, এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আমাদের ইতিহাসের ভিত্তিটি মজবুত হচ্ছে। তবে গবেষণামূলক কাজ আমাদের এখন কম হচ্ছে। আমরা জয়নুল, এস এম সুলতানদের নিয়েই পড়ে আছি।  যথেষ্ট গবেষণা না হওয়ায় মনে হচ্ছে আমরা আগের লোকজন নিয়েই পড়তে থাকতে হবে। নতুনভাবে উদ্যোগী হওয়া উচিত।

গতকালের মেলা
গতকাল মেলা চলে বিকাল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকাল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় এ এফ সালাহউদ্দীন আহ্‌মদ, মুজাফ্‌ফর আহমদ চৌধুরী, একে নাজমুল করিম শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মুনতাসীর মামুন, মীজানুর রহমান শেলী এবং সোনিয়া নিশাত আমিন। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। এ এফ সালাহউদ্দীন আহ্‌মদ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করে মুনতাসীর মামুন বলেন, অধ্যাপক সালাহউদ্দীন আহ্‌মদ বাঙালির সত্যসন্ধ ইতিহাসচর্চার এক অনন্য পুরোধা-ব্যক্তিত্ব। অসামপ্রদায়িক-মানবতাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলা ভাষা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সংস্কৃতি, ধর্মনিরপেক্ষতা, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে প্রণয়ন করেছেন অসামান্য গবেষণাকর্ম। আমৃত্যু বাংলাদেশের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক-সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে নিবিড় যুক্ততার মধ্য দিয়ে মৌলবাদ-ধর্মান্ধতা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁর সোচ্চার অবস্থান ছিল গণতান্ত্রিক-বহুত্ববাদী সমাজ-নির্মাণে আমাদের অফুরান প্রেরণার উৎস। মুজাফ্‌ফর আহমদ চৌধুরী শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করে ড. মীজানুর রহমান শেলী বলেন, অধ্যাপক মুজাফ্‌ফর আহমদ চৌধুরী ছিলেন গুণী শিক্ষক, সত্যসন্ধ পণ্ডিত এবং পরিশ্রমী লেখক। ১৯৪৮-৫২ এর ভাষা আন্দোলনের কালে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক হিসাবে তিনি তৎকালীন রাজন্যবর্গের রোষে পড়েছিলেন। যেখানে রাজনীতি জীবন, যেখানে জীবন মাতৃভাষা এবং জাতীয় স্বাধিকারের মৌল জিজ্ঞাসা; সেখানে অধ্যবসায়ী শিক্ষক হয়েও তিনি বিচ্ছিন্ন, গজদন্তমিনারচারী ছিলেন না। একে নাজমুল করিম শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করে সোনিয়া নিশাত আমিন বলেন, ড. করিম সম্ভবত উপমহাদেশের সেই পথিকৃৎ সমাজবিজ্ঞানী যিনি সমাজবিজ্ঞানের প্রয়োগপদ্ধতি নিয়ে বিশদ কাজ করেছেন। তিনি ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষকও। সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রগতিমুখিন অভিযাত্রা নিশ্চিত করতে যাঁরা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে নীরবে কাজ করে গেছেন, তাঁদের অন্যতম একে নাজমুল করিম। সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর বলেন, এ এফ সালাহউদ্দীন আহ্‌মদ, মুজাফ্‌ফর আহমদ চৌধুরী, একে নাজমুল করিম- এই তিনজন বিশিষ্ট ব্যক্তি বাঙালি মুসলমানের সমাজবিকাশের ধারাকে তাত্ত্বিকভাবে চিহ্নিত করেছেন এবং একই সঙ্গে প্রায়োগিক দিশা প্রদানের কাজটিও নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পন্ন করেছেন।
সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছিল মো. মাসকুরে সাত্তারের পরিচালানায় আবৃত্তি সংগঠন ‘বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ’-এর পরিবেশনা।  

অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা
গতকাল বাংলা একাডেমির সভাপতি ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের জন্মদিন উপলক্ষে বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করা হয়। একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খানের নেতৃত্বে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের গুলশানের বাসভবনে ফুলেল শুভেচ্ছা প্রদান করা হয়।
 
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status