দেশ বিদেশ

চুনাপাথর ব্যবসায় দুঃসময়

মানবজমিন ডেস্ক

১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, রবিবার, ৯:২২ পূর্বাহ্ন

চুনাপাথরের মজুত বলে খ্যাত সিলেটের সীমান্তবর্তী অঞ্চল, মেঘালয়। কিন্তু মেঘালয় হাইকোর্টের এক নির্দেশে এ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়েছে। সেখানে খনিজ পদার্থ সংগ্রহকারী শ্রমিকদের অবস্থাও দুর্বিষহ। এসব নিয়ে অনলাইন স্ক্রোল ডট ইন একটি ফিচার রিপোর্ট করেছে। তাতে বলা হয়েছে- জানুয়ারির এক সকাল। বাংলাদেশের ছাতক শহরের একজন ব্যবসায়ী ইলিয়াস আলী ভারতের উদ্দেশে পা চালালেন। তিনি নিজের ঐতিহাসিক শহর সিলেটকে পেছনে ফেলে তামাবিলে চলে এলেন। সেখান থেকে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত চৌকি পেরিয়ে প্রবেশ করলেন মেঘালয়ের ছবির মতো সাজানো ডাউকিতে। সীমান্ত অতিক্রম করার পর এটিই প্রথম শহর। এ শহরের অন্য সব পর্যটকের মতো নন ইলিয়াস আলী। তিনি উমঙ্গোত নদীর স্বচ্ছ পানি পাড়ি দিয়েছেন নৌকায়। এটা তার জন্য কোনো অবকাশ যাপন ছিল না। দেশে ব্যবসায় মার খাচ্ছিলেন তিনি। তা ঠিকঠাক করার মানসিকতায় পাড়ি দিয়েছেন সীমান্ত। ছাতকে তার সড়ক নির্মাণের কাঁচামালের ব্যবসা। তার রয়েছে চুনাপাথরের কতগুলো কারখানা। সেখানে চুনাপাথরকে পরিণত করা হয় কলিচুনে। অবকাঠামো খাতে এটি একটি অতি প্রয়োজনীয় কাঁচামাল। মেঘালয়ে রয়েছে প্রায় দেড় হাজার টনেরও বেশি চুনাপাথরের মজুত। তাই বছরের পর বছর ইলিয়াস আলীর ব্যবসার প্রাথমিক উৎস হলো সেই মেঘালয়। খাসিয়া পাহাড়ে ছোট থেকে মাঝারি মানের চুনাপাথরের খনি রয়েছে তার। সেখান থেকে বছরে পাঁচ থেকে সাত লাখ টন চুনাপাথর সংগ্রহ করতে পারেন তিনি। এক্ষেত্রে সাপ্লাই চেইন খুব সহজ বিষয়। খনির মালিককে মেঘালয় রাজ্যের কাছে চুনাপাথরসমৃদ্ধ এলাকায় নিজের জমি থাকতে হয়। এমন চুনাপাথর প্রধানত পাওয়া যায় খাসিয়া ও জৈন্তা পাহাড়ে। সেখান থেকে চুনাপাথর সংগ্রহ করে তা বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে পরিবহন করা হয় ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত অঞ্চল দিয়ে। তবে এক্ষেত্রে স্থানীয় বন বিভাগের কাছ থেকে নিতে হয় একটি ছাড়পত্র বা ক্লিয়ারেন্স, যা সহজেই পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে যদি উত্তোলিত চুনাপাথরের ওপর ট্যাক্স বসানো হয় তাহলে রাজ্য সরকার ভালো রাজস্ব পেতে পারে। এক্ষেত্রে মেঘালয়ের হাইকোর্ট ২০১৫ সাল থেকে বেশকিছু রায় দিয়ে এসেছে। তাতে বিষয়গুলো বার বার উল্লেখ করা হয়েছে। এক সময় চুনাপাথর ব্যবসাকে ফুলেফেঁপে ওঠার মতো করে দেখা হচ্ছিল। কিন্তু আদালতের ওই রায়ে তাতে হতাশা দেখা দেয়। ইলিয়াস আলী বলেন, ওই রায়ের পর ব্যবসায় ধস নেমেছে। আদালতের ওই রায়কে কেন্দ্র করে ব্যবসার পথ খোঁজার জন্য সরকারের দ্বারে দ্বারে ধরনা দিচ্ছেন তিনি। সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। তিনি বলেন, মেঘালয়ের চুনাপাথর ছাড়া আমরা কাজ করতে পারছি না। তাই আমি মেঘালয়ে এসেছি, যদি কিছু করতে পারি।
ইলিয়াস আলী ও তার সহব্যবসায়ীরা চুনাপাথরের জন্য অন্য উৎসের দিকে ঝুঁকে যেতে পারেন। যেমন মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া। কিন্তু মেঘালয়ের চুনাপাথর উত্তোলকদের সামনে তেমন সুযোগ নেই। একজন খনির মালিক বলেছেন, (বাংলাদেশিরা মুখ ফিরিয়ে নিলে) সব কাস্টমার হারাবো আমরা। আপনি কতদিনে আপনার নিয়মকানুন ঠিক করবেন তার জন্য সবাই তো অপেক্ষায় বসে থাকতে পারে না। তাই ব্যবসায়ীরা অন্য সরবরাহকারীদের দিকে ঝুঁকে পড়বে।

২০১৪ সাল থেকে মেঘালয়ে কয়লা উত্তোলন নিষিদ্ধ। কিন্তু চুনাপাথর উত্তোলন এখনো বৈধ। তবে ২০১৫ সালের জুনের আগে থেকে এটাও নিয়ন্ত্রিত করা হচ্ছে। এতে স্থানীয় উপজাতিগুলোর মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের উপজাতিদের তাদের নিজেদের ভূমি রক্ষার অধিকার আছে। কিন্তু তারা মনে করছেন তাদের সেই অধিকারের ওপর হাত দেয়া হয়েছে।
এ অবস্থায় আগামী ২৭শে ফেব্রুয়ারি মেঘালয়ে নির্বাচন। রাজ্যের কয়লা খনি শ্রমিকদের পাশাপাশি চুনাপাথর খনি শ্রমিকরা মনে করছেন, এই নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরবে। তামিলনাড়ু সরকারের ২০১৭ সালের জানুয়ারির একটি সিদ্ধান্তের বিষয়ে একজন চুনাপাথর খনি শ্রমিক বলেন, ভারতের দক্ষিণে যখন ষাঁড়ের লড়াই নিষিদ্ধ করলো সুপ্রিম কোর্ট তখন কী ঘটেছিল সেদিকে দৃষ্টি দিন। এক্ষেত্রে জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছিল সরকার। কিন্তু মেঘালয় রাজ্য সরকারের দিকে তাকান। তারা কিছুই করছে না।
মেঘালয় রাজ্যের ভেতর গারো পাহাড়ের বিস্তৃত ক্ষেত্র নিয়ে বর্তমান সংকটের মূল। এ নিয়ে লড়াই করছে দুটি সংগঠন। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর সুনির্দিষ্ট এলাকাগুলোতে রয়েছে তাদের কার্যক্রম ও ক্ষমতার প্রভাব। সিক্সথ শিডিউল অব দ্য কনস্টিটিউশনের অধীনে সৃষ্টি করা হয়েছে জেলা প্রশাসন। তারা রিপোর্ট করে রাজ্য সরকার ও স্বায়ত্তশাসিত জেলা পরিষদগুলোর কাছে। সংকটের শুরু পশ্চিম গারো পাহাড়ের একজন বাসিন্দা টাঙ্খাম সাঙ্গমা নামের এক ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে। গারো হিলস ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলের অনুমতিক্রমে তিনি পূর্ব গারো পাহাড়ে পরিচালনা করতেন একটি ফরেস্ট চেক গেট। সেখানে চুনাপাথর বহনকারী ট্রাকের কাছ থেকে তিনি ক্ষতিপূরণ (সম্ভবত অবকাঠামো) ফি আদায় করতেন। খনির তৎপরতায় ওই এলাকায় বনের যে ক্ষতি হয় তার বিপরীতে অর্থ সংগ্রহের জন্য গারো পাহাড়ের বিভিন্ন এলাকায় ওই একই রকম আটটি গেট স্থাপন করে জেলা পরিষদ ২০০৮ সালে। এ ব্যবস্থা পাঁচ বছরের বেশি সময় চলে। কিন্তু ২০১৪ সালের মার্চে গারো পাহাড় জেলা প্রশাসন ওইসব গেট বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দেয়। ফলে মেঘালয় হাইকোর্টে যান টাঙ্খাম সাঙ্গমা। তিনি অভিযোগ জানান, তার স্বার্থ ও অধিকার মারাত্মকভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আনক্লাসিফায়েড ফরেস্ট’কে জুরিসডিকশনের আওতায় আনছে জেলা পরিষদ। এক্ষেত্রে কোনো হস্তক্ষেপ নেই জেলা প্রশাসনের।
অভিযোগের প্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের ৩০শে জুন টাঙ্খাম সাঙ্গমাকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় পরিষদের মধ্যে সংঘাতের বিষয়টি রাজ্যের বিধায়করা মিটিয়ে ফেলতে পারেন। এক্ষেত্রে হাইকোর্টের বেঞ্চ আরো একটি নির্দেশ দেয়। তাতে বলা হয়, বন সংরক্ষণ বিষয়ক আইনের অধীনে রাজ্য যতক্ষণ পর্যন্ত লাইসেন্স না দিচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত সব রকম মাইনিং বা খনিজ পদার্থ সংগ্রহ বন্ধ রাখতে এবং তা অবিলম্বে কার্যকর করতে হবে।
আদালতের এই রায়ে এই ব্যবসা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। এর ফলে মেঘালয়ের সব রকম খনিজ পদার্থ উত্তোলন বন্ধ হয়ে গেছে। সীমান্তবর্তী ভোলাগঞ্জ গ্রামের কথাই ধরা যাক। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের একটি গ্রাম। এ গ্রামের জনসংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। তারা বলেছেন, তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন পাথর সংগ্রহ। ওই এলাকার একজন ট্রাক মালিক সঞ্জয় দেবনাথ বলেন, এক ট্রাক চুনাপাথরের সঙ্গে ২০টি পরিবারের আহারের ব্যবস্থা রয়েছে। আমাদের জন্য সরকার কিছুই করে নি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status