দেশ বিদেশ

হাসপাতালে তেজস্ক্রিয় রশ্মির ঝুঁকি নিয়েই কাজ করছেন যারা

ফরিদ উদ্দিন আহমেদ

১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, শনিবার, ৯:২১ পূর্বাহ্ন

হাসপাতালে তেজস্ক্রিয় রশ্মির ঝুঁকির মধ্যে কাজ করছেন ডাক্তার ও কর্মচারীরা। যারা রোগীকে সুপরামর্শ দিচ্ছেন, তারাই কখনও ভুক্তভোগী হয়েছেন বা হচ্ছেন। কখনও বা দুরারোগ্য ক্যানসারের মতো কঠিন রোগে ভুগেও মৃত্যুর পথযাত্রী হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এক্ষেত্রে বাদ পড়েনি তাদের সহযোগী কর্মচারীরাও। বিশেষ করে হাসপাতালে নিত্যদিন তেজস্ক্রিয় রশ্মির মধ্যে যারা কাজ করছেন তারা এই ঝুঁকির মধ্যে বেশি আছেন বলে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। নীতিমালা না মানার অভিযোগ ও পর্যবেক্ষণের অভাবও আছে অনেক ক্ষেত্রে। হাসপাতালের রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগ রেডিওথেরাপিসহ তিনটি বিভাগের সঙ্গে সম্পর্কিত চিকিৎসক ও কর্মচারীরা এই ঝুঁকিতে রয়েছেন। ক্ষতিকর তেজস্ক্রিয় রশ্মির প্রভাবে অনেককেই আজ দুরারোগ্য ক্যানসার রোগে আক্রান্ত হয়ে জীবন-মরণ সন্ধিক্ষণে লড়ছেন। অনেককে মারাও গেছেন। অতিরিক্ত রোগীর চাপের কারণে টেকনেশিয়ানরা প্রয়োজনীয় বিরতিও পাচ্ছেন না। পাচ্ছেন না ঝুঁকি-ভাতাও। হাসপাতালে নিয়ন্ত্রণ ডিভাইস (জিনিস) ব্যবহারেও ডাক্তার-কর্মচারীদের মধ্যে রয়েছে চরম অবহেলা। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গবেষণারও ঘাটতি রয়েছে যথেষ্ট। পাঁচ বছরে আপিল বিভাগের রায় বাস্তবায়নেও গড়িমসি রয়েছে বলে অভিযোগ কর্মচারীদের।
সূত্র জানায়, নিয়ম অনুযায়ী দিনে একজন টেকনোলজিস্ট ১৫ থেকে ২০ বার এক্সরে এক্সপোস দেয়ার নিয়ম থাকলেও বাস্তবে প্রত্যেক টেকনিশয়ান দিনে কমপক্ষে ৮০ থেকে ১০০ বার এক্সপোস দিতে হচ্ছে। তার পরও তারা চাপ সামলাতে পারছেন না। অন্যদিকে কয়েকগুণ বেশি চাপের কারণে আণবিক শক্তি কমিশনের নিয়ম অনুযায়ী এই তেজস্ক্রিয় সেবার সঙ্গে জড়িত টেকনেশিয়ানরা প্রয়োজনীয় বিরতিও পাচ্ছেন না। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে টেকনিশিয়ান ছাড়াও অনেক সময়ে বিভাগের পরিচ্ছন্নকর্মীও এক্স-রে মেশিন পরিচালনা করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ক্ষতিকর তেজস্ক্রিয় রশ্মির প্রভাবে কিডনিতে ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে ১৭ বছর আগে টেকনেশিান অনিল চন্দ্র ও সাখাওয়াত হোসেনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢামেক হাসপাতালের ওই বিভাগের কর্মচারীরা। এমএলএসএস (অফিস সহায়ক) হুমায়ুন কবির ল্যাং ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন অল্প কয়েক বছর আগে। অফিস সহায়ক আলী মুদ্দিনও এলপিআর (অবসর যাওয়ার প্রস্তুতি) সময় একই রোগে মারা গেছেন। চিকিৎসকদের মধ্যে বিভাগীয় প্রধান এবং ভাষাসৈনিক শহীদ আসাদের বড় ভাই অধ্যাপক ডা. মোর্শেদুজ্জামান ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। বিভাগের ডাক্তার আলতাফ হোসেনও চাকরিরত অবস্থায় ক্যানসার হয়ে মারা যান। এছাড়া মেডিকেল টেকনেশিয়ান আবু হানিফ ও আবুল কালাম প্রধান ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। বর্তমান টেকনেশিয়ান মোজাম্মেল হক আক্রান্ত হয়েছেন ক্যানসারে। তিনি চিকিৎসা নিয়ে কিছুটা সুস্থ আছেন। তবু টনক নড়েনি কর্তৃপক্ষের। দিন দিন রোগীর পাশাপাশি যন্ত্রপাতি ও টেকনেশিয়ানের চাহিদা বাড়লেও বাড়েনি যন্ত্রপাতি। বাড়েনি টেকনেশিয়ানের সংখ্যা। ঢামেকের রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের টেকনিশিয়ান (ইনচার্জ) কামাল উদ্দিন এই প্রসঙ্গে মানবজমিনকে বলেন, এই বিভাগ খুব ঝুঁকিপূর্ণ। গত ২০১৪ সালের ৬ই মার্চ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগও রেডিওলজি, রেডিওথেরাপি ও প্যাথলজি বিভাগকে হাই রিস্ক হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এরপর ২০১৭ সালের আগস্টে আদালত থেকে ঝুঁকি-ভাতার বকেয়া টাকা পরিশোধ করা জন্য একটি আদেশ দিলেও আজ পর্যন্ত কোনো বকেয়া টাকা দেয়া হয়নি বলে তিনি উল্লেখ করেন। বিভাগের টেকনিশিয়ানরা অভিযোগ করেন, পাঁচ বছর আগে আদালত রায় দিলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গড়িমসি করছে।
ঢামেক হাসপাতালের রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের একজন সহযোগী অধ্যাপক বলেন, নীতিমালা আছে। মানছে না। কঠোরভাবে নীতিমালার প্রয়োগ হচ্ছে না। নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের জনবলের অভাবে মনিটর হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন। তিনি প্রশ্ন করে বলেন, তা না হলে এই বিভাগে এতগুলো লোক মারা গেলে কীভাবে। আগে এই বিভাগের ডাক্তার-কর্মচারীরা ইউজার ফি’র ৫০ শতাংশ পেতেন। তাও বন্ধ করে দিয়েছে ২০১২ সালের অক্টোবরে; যা ব্রিটিশ আমলে থেকে পেয়ে আসছিল। ২০১৪ সালে আদালতের রায় আমাদের পক্ষে থাকার পরেও মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করে। আবার তা একদিন পরই বন্ধ করে দেয়। এটা কোনোভাবে কাম্য নয়। এই বিষয়ে ঢামেক হাসপাতালের রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. নোমান চৌধুরী মানবজমিনকে বলেন, আমাদেরকে আদালত খুব ঝুঁকিপূর্ণ বিভাগ হিসেবে বলেছেন। অন্যদের তো বলেননি। প্রশাসন যখন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে যায় তখনই অন্যরা এর বিরোধিতা করেন। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয় বলে তিনি মন্তব্য করেন।
বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের এক মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, তেজস্ক্রিয় রশ্মি নিয়ন্ত্রণের জন্য অবশ্যই বিভিন্ন ডিভাইস ব্যবহার করতে আইসিআরপি (আন্তর্জাতিক কমিশন অন রেডিওলজি প্রক্টের) নীতিমালা রয়েছে। এক্স-রুমগুলো এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে বাইরে তেজস্ক্রিয় রশ্মি না যেতে পারে। বিশেষ করে ক্যাথল্যাব-এর বিষয়টি বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলে তিনি উল্লেখ করেন। যথেষ্ট পরিমাণে প্রক্টেট নিয়ে কাজ করতে হবে। লিড গ্লাস ও এপ্রোন ব্যবহার করতে হবে। গলায় থাই মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। সঙ্গে অন্যান্য ডিভাইসও ব্যবহার জরুরি। এগুলো সব জায়গায় আছে কি না প্রশ্ন রয়েছে। এগুলো ব্যবহার করলে তেজস্ক্রিয় রশ্মির মাত্রা অনেক কমে যায় বলে তিনি উল্লেখ করেন। আর যত মাত্রা কমানো যায়, ততই নিজে নিরাপদ থাকবেন বলে তিনি মনে করেন। দক্ষ কর্মী হিসেবে মেডিকেল ফিজিসিস্ট নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট কাজের এসব দক্ষ জনবলের মাধ্যমে মাত্রা কমানো সম্ভব বলে তিনি মনে করেন। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, এসব মেডিকেল ফিজিসিস্টরা অনেকটা অভিজ্ঞ হবেন। সংশ্লিষ্ট বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্র্তৃপক্ষ রয়েছে। তারা লাইসেন্স দিয়ে থাকেন। কতগুলো শর্তপূরণ করলে এই লাইসেন্স দেয়া হয়। সময়ে সময়ে নবায়ন করতে হয় লাইসেন্স। এই নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের দক্ষ জনশক্তির অভাব রয়েছে। ঠিক সময়ে সঠিকভাবে মনিটর হয় না; বিধায় এ রকম ঘটনা ঘটছে বলে তিনি মনে করেন। সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠানগুলো নীতিমালাও মানছে না। আইসিআরপি নিয়ম অনুয়াযী একজন ব্যক্তি শরীরে বছরে ২০ মিলিসিভার্ট তেজস্ক্রিয় ঢুকতে পারে। এর ব্যতিক্রম হলে তাকে অন্য জায়গায় সরিয়ে দিতে হবে। বাংলাদেশে এই নিয়ম অনুসরণ কম হচ্ছে বলে এই বিশেষজ্ঞ মনে করেন।
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status