দেশ বিদেশ

চট্টগ্রামে অবহেলায় পড়ে আছে প্রত্নসম্পদ

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি

১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, শনিবার, ৮:৫২ পূর্বাহ্ন

চট্টগ্রামে অবহেলায় পড়ে আছে ইতিহাসের ধারক প্রত্নসমপদ। নেই অনুসন্ধান, গবেষণা ও সংরক্ষণের উদ্যোগ। ফলে অন্তরালেই থেকে যাচ্ছে প্রত্নতাত্ত্বিক মূল্যবান এ সম্পদ। বঞ্চিত হচ্ছে প্রাগৈতিহাসিক ও ঐতিহ্য সম্পর্কে জানা থেকেও।
উন্নত বিশ্বে প্রত্নসম্পদ নিদর্শনের খোঁজে যেমন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রয়েছে। তেমনি মূল্যবান সম্পদ হিসেবে রয়েছে সংরক্ষণের ব্যবস্থাও। এ খাতে গড়ে উঠেছে প্রচুর কর্মসংস্থান। যা আমাদের দেশের কোথাও গড়ে উঠেনি।
অথচ চট্টগ্রামেও প্রত্নসম্পদ খাতে রয়েছে প্রচুর কর্মসংস্থানের সুযোগ। এমনটাই জানালেন চট্টগ্রাম প্রত্নসম্পদ বিভাগের পরিদর্শক শাহীনুজ্জামান শাহীন।
তিনি বলেন, সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে কালে কালে নানা দেশের মানুষ চট্টগ্রামে আসে। মুঘল শাসনামল থেকে এসব মানুষ নিজেদের প্রয়োজনের তাগিদে গড়ে তুলে নানা স্থাপনা। ব্যবহার করে নানা শিল্পশৈলী। যা বর্তমানে প্রত্নসম্পদ হিসেবে পড়ে রয়েছে।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মতো চট্টগ্রামেও হাতেগোনা প্রত্নসম্পদের নিদর্শন খুঁজে পাওয়া গেলেও সিংহভাগ রয়ে গেছে অন্তরালে। যা খুঁজে বের করার উদ্যোগ নেই। অথচ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় চট্টগ্রাম অঞ্চলের জনপদের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে পালা বদলের নানান ধারা যুক্ত হয়েছে বেশি। প্রধান নৌ-বন্দর হওয়ার বদৌলতে এই চট্টগ্রাম ভূমিতে বহু বিচিত্র জাতি জনগোষ্ঠী ও শাসকের সমাবেশ ঘটেছে।
প্রত্নসম্পদ গবেষক, কথাসাহিত্যিক সামশুল হক এ প্রসঙ্গে বলেন, এখানে এসেছে এবং মিশ্রিত হয়েছে আর্য-অনার্য, আরব-পাঠান-মুঘল, আরাকানি-ইংরেজ-পর্তুগীজসহ নানা বর্ণ, নানা ধর্ম-সংস্কৃতিধারী মানবগোষ্ঠী। এদের কেউ এসেছে ব্যবসাসূত্রে, আবার কেউ এসেছে দেশ শাসনের অভীপ্সা নিয়ে।
ফলে চট্টগ্রাম এলাকার জনসমাজ ও এর সংস্কৃতি, লোকবিশ্বাস, ইতিহাস, জীবনযাপনের নানান কৌশল ও পদ্ধতি নানান অভিজ্ঞতার সংসপর্শে এসে তারাও সমৃদ্ধ হয়েছে। দেখা যায়, তৎকালে নির্মিত নানা স্থাপনায়, মন্দিরে, মসজিদে-প্যাগোডায়, সরাইখানা, দুর্গ, হর্ম্য, বিহার, প্রাচীর, মিনার, স্তম্ভ, শিলালিপি, তাম্রশাসন, মুদ্রা, জলাশয়, স্মৃতিসৌধ ইত্যাদিতে তাই মিশ্রণ ঘটেছে কোথাও কোথাও।
এসব সুপ্রাচীন ইতিহাস ও স্থাপত্যকীর্তি একের সঙ্গে অন্যের যোগসূত্র ও পরমপরা উদঘাটনের উপাদান। এসব নিয়ে গবেষণা ও বিশ্লেষণ, এখনো অস্তিত্বময় প্রত্ন-সমপদগুলোর সংরক্ষণ এবং উপস্থাপনা ও প্রচার-প্রসার আমাদের দেশের আর্কিওলজিক্যাল ট্যুরিজমের দিগন্ত উন্মোচিত করে দিতে পারে। খনন কর্মের মধ্য দিয়েও আত্মপ্রকাশ করতে পারে আরো মহৎ কোনো পুরাতাত্ত্বিক আবিষ্কার।
অথচ উন্নত বিশ্বের চিত্র পুরোই উল্টো। আমেরিকা, বৃটেন, সুইজারল্যান্ড, চীন এমনকি অনুন্নত দেশ ভারতেও রয়েছে প্রত্নসম্পদ নিদর্শন সংরক্ষণ, গবেষণা ও অনুসন্ধানের যথেষ্ট ব্যবস্থা। এ খাতে সরকারি ব্যবস্থার পাশাপাশি বেসরকারি খাতেও গড়ে উঠেছে অনেক প্রতিষ্ঠান। যেখানে কর্মসংস্থান হয়েছে লাখ লাখ লোকের। যারা প্রতিনিয়ত ছুটে বেড়ায় প্রত্নসম্পদের খোঁজে।
বাংলাদেশেও এ খাতে যথেষ্ট কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কোনো উদ্যোগ নেই। কেউ এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করলে সেই প্রচেষ্টাকে অবশ্যই স্বাগত জানাতে হবে। যতোই ক্ষুদ্র হোক আয়োজন, হোক সীমিত পরিসরে, এর প্রভাব-প্রতিক্রিয়া সমাজের মাঝে প্রভাব বিস্তারকারী হবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পালিত বিভাগের অধ্যাপক ড. জিনবোধি ভিক্ষু বলেন, আমাদের এই এলাকার প্রত্নসমপদের প্রতি দৃষ্টি ফেরানোর জন্য সরকারি- বেসরকারি যেকোনো উদ্যোগ সময়োপযোগী হতে পারে। এদেশকে চেনার জন্য, দেশের সঙ্গে একাত্মতা উপলব্ধি করার জন্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে আত্মস্থ করে দেশব্রতী প্রকৃত মানুষরূপে নিজেদের চিহ্নিত ও আত্মপ্রকাশ করার জন্য দরকার দেশের সত্যিকারের পরিচয় ও তার সঙ্গে আন্তরিক সংযোগ।
তিনি বলেন, যে ভূখণ্ডে কোনো ব্যক্তির জন্ম, জীবনযাপন, সার্বিক দিক থেকে পূর্ণমাত্রায় বিকশিত হয়ে বেড়ে ওঠা, সেই সঙ্গে সেই ভূখণ্ডের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ক্রমবিবর্তনের ধারাকে যথাযথভাবে অবগত হওয়ার সুযোগ না পেলে সে ব্যক্তির দেশাত্মবোধের টান যে নিখুঁত হবে না- একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। এলাকার পুরাকীর্তির প্রতি আগ্রহ জনগণকে আলোর সন্ধান দিতে পারে।
আত্মপরিচয়ের শেকড় দেশের সঙ্গে গভীরে গ্রোথিত করতে হলে এর বিকাশের ধারা, প্রাচীন ইতিহাসের কাহিনী, কীর্তি ও প্রত্ন-সমপদরাজির সঙ্গেও আমাদের একটি সমপর্ক তৈরির কথা ভাবতে হবে। অর্থাৎ ঐতিহ্যের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ধারার সঙ্গে এর মাধ্যমে যেমন আমরা আমাদের পরিচয় ঘটাবো, তেমনই ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত ও তার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহের কাছেও আমরা ফিরে যেতে পারবো। আমাদের গড়ে ওঠা, সৃষ্টি ও নির্মাণ এবং গৌরব ও অগ্রযাত্রার পথ চলাকে পরিপূর্ণভাবে চিনতে ও জানতে হবে। আত্মপরিচয় সমপর্কে আস্থা থাকতে হবে।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার প্রত্ন-নিদর্শন ও সমপদ নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা ও সন্ধান-অনুসন্ধান চললেও চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক নির্মাণ, স্থাপনা ও প্রত্ন-নিদর্শনগুলোর বিষয়ে অনেকটাই অনাগ্রহ চোখে পড়ে। এটা কোনো উদ্দেশ্যমূলক আচরণ, তা বলা যাবে না। প্রকৃতপক্ষে এদেশের পুরাতত্ত্ব বিষয়ক নানা ধরনের গবেষণা কর্মকাণ্ড এবং প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজনগুলো এখনো মনে হয় তাদের শৈশবকাল অতিক্রম করতে পারেনি। এ সমস্ত কাজের পেছনে যে আগ্রহ-একাগ্রতা দরকার কার্যত তারও অভাব রয়েছে এবং পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনাবলী খুঁজে বের করা, সংরক্ষণ করা এবং গবেষণা পরিচালনা ইত্যাদির জন্য যে পরিমাণ অর্থায়ন আবশ্যক তাতেও ঘাটতি রয়েছে।
দেশের সকল স্থানের বিদ্যমান নিদর্শনাবলী নিয়ে গবেষণা, সমীক্ষা ও সন্ধান-অনুসন্ধান করে তারই ভিত্তিতে সমাজ-সংস্কৃতি, রাজনীতি ও বিকাশের গতিধারার আলোকে জাতির ইতিহাসের পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা অঙ্কন করতে চাইলে প্রত্নতত্ত্ব পরিদপ্তর কর্তৃক অনুসৃত পরিকল্পনা-প্রকল্প ইত্যাদিকে আরো অনেক গতিশীলতা দেয়ার কথা আমাদের নীতি-নির্ধারক মহলকে ভাবতে হবে। উদ্যোগ নিয়ে পাল, সুলতানী, মুঘল আমলের চট্টগ্রামের ইতিবৃত্ত, সমাজ ও প্রাচীন ঐতিহ্য সমপদকে জনসমক্ষে উন্মোচিত করতে হবে। তাতে জাতির গর্বের উপাদান পাওয়া যাবে।
দেশের পুরাকীর্তির সঙ্গে এদেশের মানুষের যে বর্তমান বিচ্ছিন্নতা রয়েছে তাকে দূর করতে হলে পাঠ্যক্রমের মধ্য দিয়ে আমাদের নবীন প্রজন্মকে এ সমপর্কে আগ্রহী করে তুলতে হবে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status