বই থেকে নেয়া

উত্তম কুমারের অজানা কথা (২৮)

‘অনেকে স্পষ্ট করেই বলল, তুই ফ্লপ মাস্টার জেনারেল’

১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, শুক্রবার, ৩:১৬ পূর্বাহ্ন

বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি মহানায়ক উত্তম কুমার অনন্য অভিনয় জাদুতে মুগ্ধতা বিলিয়েছেন দুর্নিবার। তার অভিনীত ছবি মানেই ভালোলাগার এক বিশাল প্রাপ্তি। পর্দায় এ নায়ক যেমন উজ্জ্বল তেমনই তার ব্যক্তিজীবনের চলাচলেও ছিল নানান রঙের মিশেল। সেই অজানা জীবনের গল্প তার বয়ান থেকে অনুলিখন করেছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক-সাহিত্যিক গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ যা পরবর্তী সময়ে ‘আমার আমি’ নামে বই আকারে প্রকাশ হয়। সে বই থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে উত্তম কুমারের আত্মজীবনী-

আমি বিন্দুমাত্র বিলম্ব না করে বিমলবাবুকে আমার ঠিকানাটা জানিয়ে দিলাম। তার কিছুদিনের মধ্যে ‘মর্যাদা’ ছবির কাজ শেষ হয়ে গেল।
আবার আমার শিল্পী-জীবনের বেকার অবস্থা নিয়ে আমি সম্পর্ণ একা হয়ে গেলাম। আবার সেই চাকরি-জীবনের আবর্তে ঘুরপাক খাওয়া শুরু হয়ে গেল।
‘মর্যাদা’ অবশেষে মুক্তি পেল ১৯৫০ সালে। অবশ্যই আমার বিয়ের অনেক পরে। এই ছবির মুক্তির পরও আমার সেই আগেরই মতো অবস্থা। ‘মর্যাদা’র রিলিজিং হাউসের পাশাপাশি অবসর সময়ে ঘুরে বেড়াই। আমার অভিনয় প্রসঙ্গে দর্শকদের মন্তব্য শোনার আগ্রহের চেয়েও দর্শক-সমাগমের মাত্রা দেখাই ছিল সেদিন আমার একমাত্র আকাক্সক্ষা।
ছবিটা প্রথম দিকে ভালো চলছিল। হঠাৎ যেন কী দিয়ে কী হয়ে গেল! ‘মর্যাদা’র প্রতি দর্শকদের আগ্রহ কমে গেল। এ যেন আমারও অক্ষমতা। ভাগ্য বিড়ম্বনা!
অশান্তির বিষাক্ত পোকাগুলো যেন আমার ভেতরে কিলবিল করছিল। এভাবে একটার পর একটা ছবি যদি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় তা হলে যে আমারও ব্যর্থতা! অথচ সেই ব্যর্থতা থেকে নিজেকে সরিয়ে আনার ক্ষমতা কোথায়?
দর্শকের আদালতে সুক্ষ্ম বিচার তো হবেই।
হলোও তাই। ‘মর্যাদা’ ফ্লপ করল।
লজ্জায় আমি যেন মাথা তুলে তাকাতে পারি না কারও দিকে। আমার অভিনয়ের ত্রটিতে যে ছবিটা এমন হয়েছে তা কেউ বললেন না, তবে এ লজ্জা কেন! আমি জানি লজ্জা পাচ্ছি ‘মর্যাদা’র ব্যর্থতাকে ঘিরে।
বন্ধুরা আবার নানা শ্লেষ উক্তিতে আমাকে রীতিমতো আঘাত করতে শুরু করল। অনেকে স্পষ্ট করেই বলল, তুই ফ্লপ মাস্টার জেনারেল।
অহেতুক অপমানে আমার ভেতরকার মানুষটা ক্ষতবিক্ষত হতে থাকল। আমার পতনের একটা ছবি যেন স্পষ্ট আমি দেখতে পাচ্ছি।
এবার আমার বিয়ের কথাটা সেরে নিই। কথায় কথায় দু’বছর এগিয়ে এসেছি। ফিরে যাই দু’বছর পিছনে। ১৯৪৮ সালের ১লা জুন আমার বিয়ে হয়েছিল। সব রকম শাস্ত্রীয় অনুশাসন মেনে মোটামুটি সমারোহের সঙ্গেই হয়েছিল। তারপর শুধু ছবি করে যাওয়া। শুধু কাজ আর কাজ। তারপর এগিয়ে এল আমার বহু আকাক্সিক্ষত ৭ই সেপ্টেম্বর।
১৯৫০ সালের এই তারিখটা যেন দ্রুত এগিয়ে আসতে লাগল। এই সেই আমার জীবনের আর এক একান্ত আপনার তারিখ।
এই শুভদিনের শুভক্ষণে গৌতম এসেছিল এই চাটুজ্জেবাড়ির উত্তরাধিকারী হয়ে।
ছবি ফ্লপ করলে সেদিক থেকে আমার দুশ্চিন্তার যেমন সীমা পরিসীমা ছিল না তেমনি আমি আমার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যখন রীতিমতো সন্দিহান ঠিক সেই সময় আর একটা ঘটনার শুভ সূচনায় আমার মন আনন্দে-খুশিতে ভরে থাকত। তা হলো গৌরী অন্তঃসত্ত্বা। গৌরী মা হতে চলেছে, আমার একমাত্র সন্তানের মা।
গৌরীকে আমি, লালু আরও কয়েকজন শিশু মঙ্গল হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ে এলাম। সারাদিন শুধু ভাবনা। ৬ই সেপ্টেম্বর সারাটা দিন এই দুশ্চিন্তা-ভাবনার মধ্যে কাটল। কী পাব- কে আসছে- ছেলে হবে না মেয়ে, আমাদের সেই নিয়ে জল্পনা। এই সেপ্টেম্বরে আমার জন্ম, এই সেপ্টেম্বরে গৌরীর জন্ম আর এই সেপ্টেম্বরেই আমার সন্তান আসছে! ৭ই সেপ্টেম্বর ভোর রাতে শচীন লালু খবর নিয়ে এল গৌরীর ছেলে হয়েছে। প্রথম সন্তান ছেলে, সেই আনন্দে আমি সেদিন দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম। ‘মর্যাদা’র ব্যর্থতার জ্বালা আমি ভুলে গেলাম।
আবার নিজেকে সুন্দরভাবে সাজাতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। অফিসের বাঁধাধরা চাকরির পর গৌরী আর নবজাতকের সান্নিধ্য।
বেশ সহজ-সুন্দর আর সাধারণভাবেই আমাদের জীবনযাত্রা চলছিল। হাসিতে-খুশিতে আমরা দু’জনকে ভরিয়ে রেখেছিলাম। এমনি করেই একটা বছর কেটে গেল। এর মধ্যে মাঝে মাঝে আমার স্বপ্নকে সার্থকক করে না তুলতে পারার যন্ত্রণা যে আমাকে কাতর করে তুলছিল না তা নয়।
আমার আত্মবিশ্বাস ছিল। ছিল আন্তরিক নিষ্ঠা। চরম একাগ্রতা। ছিল একান্ত শ্রদ্ধা। কিন্তু আমার ভাগ্যদেবতা জানি না কেন আমার প্রতি প্রসন্ন ছিলেন না। আমি ‘মর্যাদা’ ছবির পর ধরেই নিয়েছিলাম ফিল্মে আর কেউ আমাকে সুযোগ দেবেন না। ভেবেই নিয়েছিলাম আর কেউ আমাকে আপন করে ডেকে নেবেন না। নিতে চাইবেন না। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আমি বেঁচে রইলাম।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status