এক্সক্লুসিভ

‘কাছে আসার সাহসী গল্পটা’ হোক অন্যরকম!

রফিকুজ্জামান রুমান

১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, বুধবার, ৯:২৪ পূর্বাহ্ন

‘সখি, ভালোবাসা কারে কয়’ বলে রবীন্দ্রনাথ সেই কবেই ভালোবাসকে বিমূর্ত (Abstract) বলে রায় দিয়ে গেছেন! সেটি না দিলেও চলতো। কারণ ভালোবাসা বিমূর্তই; প্রকৃতির সবচেয়ে সহজাত, সবচেয়ে প্রাণের বিষয়টি হলো ভালোবাসা। এ বোধ হয় একমাত্র ভালোবাসাই যা কাউকে শিখিয়ে দিতে হয় না, কাউকে বলে দিতে হয় না এই হলো ভালোবাসা! এ হলো ফুলের সৌন্দর্যের মতো; নিজের থেকেই ছড়িয়ে পড়ে তার সৌরভ। ঝরণার পানির মতো; আপন পথেই বয়ে যায় অবিরাম! সূত্র নেই, নিয়ম নেই, ব্যাকরণ নেই। এসব নেই বলেই ভালোবাসার নেই কোনো সংজ্ঞাও। ভালো সবকিছুই ভালোবাসা। কিন্তু আমরা এমন নিবিড় মানবিক ভালোবাসাকে বক্সবন্দি করে ফেলেছি ভোগ আর উদযাপনের আড়ম্বরে। সত্যিকারের ভালোবাসার মাটির উপরে দাঁড় করিয়ে দিয়েছি কংক্রিটের কৃত্রিম অট্টালিকা। ভালোবাসার বিশাল পরিধিকে সংকীর্ণ করে গড়ে তুলেছি ভোগের চাকচিক্যময় সাম্রাজ্য। ভোগের লালসায় নিঃশেষ হয়ে গেছে অনুভূতির শেষ বিন্দুও। লাগামহীন পুঁজির বিনিয়োগে ‘পণ্য’ করে ফেলেছি ভালোবাসাকে। এই মানুষের, এই সময়ের সত্যিকারের পরিচয় কী? উপাসক! আমরা ক্রমান্বয়ে উপাসক হয়ে উঠছি। আমাদের রক্তে, মাংসে, মজ্জায় শুধু উপাসনা। পণ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের প্রভু। এই বাংলাদেশের একেকজন মানুষ একেকজন পণ্য-উপাসক। পুঁজি, প্রযুক্তি, প্রচারমাধ্যম- সব একাট্টা হয়ে আমাদের শিরায় শিরায়, আমাদের মননে আর মগজে অবিরাম বয়ান করে চলেছে- আরো চাও, আরো চাও। আমাদের জীবন শেষ হয়, চাওয়া শেষ হয় না। আমরা তো চেয়েছিলাম মুক্তি। শুধু একটি মানচিত্র আর পতাকা চাইনি। আমরা তো চেয়েছিলাম স্বাধীনতা। শুধু লাখো কণ্ঠে জাতীয় সংগীত গেয়ে বিশ্বরেকর্ড করতে চাইনি। আমরা তো চেয়েছিলাম ভালোবাসা। নরম, কোমল, দখিনা হাওয়ার মতো স্নিগ্ধ নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। পণ্যের মোড়কে ভোগসর্বস্ব ভালোবাসা নয়। আমরা প্রেমিক হতে চেয়েছিলাম। আমাদেরকে বানানো হয়েছে ভোক্তা। বিশ্বাস করুন, ভালোবাসা দিবসের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক নেই। ‘যে প্রেম স্বর্গ থেকে এসে জীবনে অমর হয়ে রয়,’ ভালোবাসা দিবসের প্রেম সেই প্রেম নয়। এই প্রেম বোঝে পুঁজি আর ভোগ। না হলে ভালোবাসার মতো এমন কোমল মানবীয় বিষয়ের উদযাপনে দিবসের প্রয়োজন হবে কেন? এটি পুঁজিবাদের সৃষ্টি এবং দিন শেষে পুঁজির কাছেই এর আত্মসমর্পণ। যতো দিবস, ততো উদযাপন। উদযাপনের নানা রঙিন আয়োজনে পুঁজির বিনিয়োগ। পণ্য উৎপাদন। অতঃপর সেই পণ্যই হয় আমাদের উদ্দীষ্ট। আস্তে আস্তে আমরা হয়ে পড়ি পণ্যের উপাসক। অবিরাম ভোক্তা। ভোগের এই দুষ্টচক্রে ভালোবাসা তো হারায়ই; সবচেয়ে বেশি হারায় মানবিক বোধ। তার রেশ রয়ে যায় জীবনের সর্বত্র। গড়ে ওঠে বৈষম্যের অমানবীয় এক সমাজ।
মাস্টারকার্ডের ‘কনজ্যিুমার পারচেজিং প্রায়োরিটিজ’ শীর্ষক এক জরিপে দেখা যায়, গেল বছরের ভালোবাসা দিবসে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মানুষেরা নিজেদের ভালোবাসার মানুষকে উপহার দিতে প্রত্যেকে গড়ে ৬৮০ টাকা (৭১ ডলার) করে ব্যয় করছে। জরিপে ১৮টি দেশের নয় হাজার ১২৩ জন ব্যক্তি অংশ নেয়, যাদের বয়স ১৮ থেকে ৬৪ বছর। এই ৬৮০ টাকার (কোথাও কোথাও টাকার পরিমাণ আরো অনেক বেশি) বিনিয়োগই হলো পুঁজিবাদের মূলমন্ত্র! ভালোবাসা দিবস না থাকলে এই খরচটি হতো না। তাই এটি একটি অহেতুক খরচ। অপ্রয়োজনের খরচ। পুঁজিবাদকে টিকিয়ে রাখার এই হলো তরিকা। প্রয়োজনের চাহিদা পূরণের ক্ষমতা অর্জনের পর পণ্য উৎপাদনের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য দরকার অপ্রয়োজনের ‘চাহিদা’ সৃষ্টি। ৬৮০ টাকার উপহার তাই আর ভালোবাসার প্রকাশ নয়; প্রকারান্তরে পুঁজিরই প্রসার। এই পুঁজির হাতেই বর্তমান বিশ্ব নিজেকে সঁপে দিয়েছে। ভোগের বাইরে পৃথিবীর আর কোনো বাস্তবতা নেই।
অথচ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) জানিয়েছে, প্রতি রাতে বিশ্বের প্রায় ৮০ কোটি লোক ক্ষুধা নিয়ে ঘুমাতে যায় (দৈনিক ইত্তেফাক, ৬ ডিসেম্বর, ২০১৬)। আমাদের বাংলাদেশেও কতো মানুষ এখনো দু’বেলা পেট ভরে খেতে পারে না। অভাবের তাড়না সইতে না পেরে আত্মহত্যার মতো নির্মম ঘটনাও ঘটছে এই বঙ্গদেশে। ফরিদপুরের নগরকান্দায় অর্থকষ্ট সইতে না পেরে পঙ্গু কৃষক শেখ সহিদ আত্মহত্যা করেছেন গলায় ফাঁস দিয়ে (দৈনিক যায়যায়দিন, ১লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৮)। ঋণের কিস্তির টাকা দিতে না পারায় লালমনিরহাটের আদিতমারিতে আত্মহত্যা করেছে খোরশেদ আলম নামের এক কৃষক (যুগান্তর, ৩১শে জানুয়ারি, ২০১৮)। এমন আরো অনেক উদাহরণের মাঝেও থেমে নেই আমাদের ভোগ বিলাস। বৈষম্যের পাহাড় রচনা করে চলেছি প্রতিনিয়ত। সোনারগাঁ হোটেলে এক কাপ চায়ের দাম ১৯৪ টাকা। অথচ যাদের শ্রমে আর ঘামে চা উৎপাদিত হয়, সেই চা বাগানের একজন শ্রমিকের প্রতিদিনের মজুরি ৬৯ টাকা! এই ঢাকার শহরে কতো পরিবার আছে যাদের প্রতিদিনের সকালের নাস্তা যায় ফাইভ স্টার হোটেল থেকে! অথচ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিলকিস বেগমের কাছে জীবন কতো নিষ্ঠুর! অভাবের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে মাত্র পাঁচ শত টাকার বিনিময়ে দেড় বছরের শিশু সন্তানকে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন এই গর্ভধারিণী মা (যুগান্তর, ২৯শে জানুয়ারি, ২০১৭)। কুড়িগ্রামের রেবি খাতুন তার ২২ দিনের সন্তানকে বিক্রি করে দিয়েছেন। সন্তান বিক্রির টাকা দিয়ে কোনোমতে তুলেছেন একটি ঘর (বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম)। সাভারের একটি হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে টাকা দিতে না পারায় দুই রোগীকে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে হাসপতালে আটকে রাখা হয়। এদের একজন মানিকগঞ্জের রাজবানু আবার এক মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী (প্রথম আলো, ২০শে নভেম্বর, ২০১৫)! তথাকথিত এই ভালোবাসা উৎসবকে উপলক্ষ করে চারদিকে হুলস্থূল আয়োজন। সংবাদপত্রগুলো ছাপছে বিশেষ ফিচার/খবর, টেলিভিশন চ্যানেলগুলো প্রচার করছে পাঁচ/সাত দিনব্যাপী ‘বর্ণিল’ অনুষ্ঠানমালা। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো খুলে বসেছে নানা ইভেন্ট। কেউ কেউ মঞ্চস্থ করছে ‘কাছে আসার সাহসী গল্প!’ কাছে আসায় কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু যে ‘কাছে আসা’কে এখানে উপজীব্য করা হয়েছে, প্রশ্ন তা নিয়েই। সত্যিকার অর্থে এই ‘কাছে আসা’ হলো প্রবৃত্তি, সহজাত; এর জন্য ‘সাহসের’ প্রয়োজন নেই। সমাজ, সংস্কৃতি ও নৈতিক মূল্যবোধকে ধারণ করে যে ‘কাছে আসা’ সংঘটিত হয়, তার মধ্যে সাহসের কিছু নেই; একটি স্বাভাবিক প্রবৃত্তিগত প্রক্রিয়া। বরং ‘কাছে আসার’ সেই গল্পগুলোই হতে পারে সাহসী যেখানে বিরুদ্ধ পরিবেশে কারো কাছে গিয়ে নিঃস্বার্থ বলা যায় ‘আমি আপনার জন্য কী করতে পারি।’ একটি পথশিশুর কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে জানতে চাওয়া ‘তুমি দুপুরে খেয়েছ কিনা’-ই হলো সত্যিকারের ‘কাছে আসা।’ রাস্তা পার হতে না পারা বৃদ্ধকে হাত ধরে পার করিয়ে দেয়া হলো সত্যিকারের ‘কাছে আসা।’ ঋণের কিস্তির টাকা দিতে না পেরে আত্মহত্যা করা খোরশেদ আলমকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা হতে পারত ‘কাছে আসার সাহসী গল্প।’ অভাবের যন্ত্রণা বিলকিস বেগমের কাছ থেকে দেড় বছরের শিশুকে দূরে নিয়ে গেছে। ভালোবাসা দিবস উদযাপনের যাবতীয় খরচ দিয়ে এরকম অসংখ্য বিলসিক বেগমের অভাব দূর করা যেত। শিশু ফিরে আসত মায়ের কাছে। রচিত হত সত্যিকারের ‘কাছে আসার সাহসী গল্প।’ আধুনিক স্বার্থপর জীবনযাপনের ‘প্রাইভেসি’ রক্ষার নামে বৃদ্ধ বাবা মা’কে বৃদ্ধাশ্রমে না পাঠিয়ে নিজের কাছে রাখার মাধ্যমে ‘কাছে আসার যে গল্প’ নির্মিত হতে পারত, তা-ই হত ভালোবাসার সার্থক অনুবাদ।
এমন গল্পই আজ বেশি প্রয়োজন। এই ভালোবাসাই মানবিক ভালোবাসা। কাছে আসার সাহসী গল্পগুলো এমনই হোক!
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status