মত-মতান্তর
একাত্তর: আগে-পরে(১৯)
ওটা যেন আমার মৃত্যু পরোয়ানা ছিল
৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, শুক্রবার, ১:৩৬ পূর্বাহ্ন
ছাত্রলীগের কমিটি নিয়ে কাউন্সিলরদের রুদ্ধদ্বার আলোচনার এক পর্যায়ে তোফায়েল আহমদ বলেন, চলেন একটু নির্জনে চা খেয়ে আসি। খানিকটা হেঁটে তোফায়েল আহমেদের জন্য নির্ধারিত গাড়িতে উঠে বসলে অল্পক্ষণের মধ্যে আমরা পৌঁছে যাই ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে। বুঝতে বাকি রইলো না
এটি ছিল কৌশল। বঙ্গবন্ধু দোতলায় আমাদের অপেক্ষায়। আমাদের দেখে তিনি চেহারায় গাম্ভীর্যের ভাব এনে আমার হাতে দুই পৃষ্ঠার কাগজ ধরিয়ে দিলেন। আড়চোখে তাকিয়ে দেখি এটি নবগঠিত ছাত্রলীগের প্রস্তাবিত প্যানেল। ঘটনাক্রম এভাবেই এগিয়ে যায় চূড়ান্ত পরিণতির দিকে। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক নূরে আলম সিদ্দিকীর ধারাবাহিক সাক্ষাৎকারের আজ পড়ুন ১৯তম কিস্তি:
ঠিক হলো সেপ্টেম্বরের দিকে আরেকটি সম্মেলন হবে অনেক জাঁকজমকভাবে তবে ভুল বোঝাবুঝি নিরসনের জন্য ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে নেতা ও কর্মীরা সমবেত হবেন যেখানে তোফায়েল আহমদ ও আমি একসঙ্গে বক্তৃতা করবো। আমি এমনিতেই আবেগতাড়িত লোক এই সুযোগটি আমাকে আপ্লুত করে; উদ্বেলিত করে। আমি মনঃস্থির করি, সম্মেলনে আমি বুদ্ধি উজাড় করে অনুভূতির সমস্ত আবির মাখিয়ে বক্তৃতা করবো। উদগত, উদ্বত, উদ্বত্য পূর্ণায়ত পদ্মটির মতো নিজেকে মেলে ধরবো। করেছিলাম-ও তাই। আবেগে মায়ের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে প্যারোল না পাওয়ার ঘটনা থেকে শুরু করে ছাত্রলীগের জন্য আমার হৃদয়ের পুঞ্জীভূত ভালোবাসার সব উপমাগুলোকে মর্মস্পর্শী ভাষায় সাজিয়ে, চোখের জলে বুক ভাসিয়ে এক ঘণ্টার ওপরে করা বক্তৃতাটি এতই আবেগ-উচ্ছ্বাসের সৃষ্টি করে যে আমি শতভাগ নিশ্চয়তার সঙ্গে বলতে পারি পরবর্তীকালে ছাত্রলীগের সভাপতি হওয়ার প্রশ্নটি এখানেই স্থির হয়ে যায়। বাংলা ছাত্রলীগ গঠনের যে অপবাদটি আমার নামে ছড়ানো হয়েছিল তার পুঙ্খানুপুঙ্খ জবাব দিয়ে আমি বলেছিলাম, ‘কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিবে যে, সে পূর্বে মরে নাই।’ মুজিব ভাই তার গৃহে উপস্থিত সব নেতৃত্বকে পরামর্শ দিলেন তোফায়েল ও আলম একসঙ্গে সাংগঠনিক সফর করে বেড়াতে যাতে ভুল বোঝাবুঝির সব অবকাশ শেষ হয়ে যায়। এ উদ্দেশ্যে প্রথম সম্মেলন নারায়ণগঞ্জে আহূত হয়। সেখানকার বালুর মাঠে অনেকের সঙ্গে তোফায়েল আহমদ ও আমি বক্তৃতা করি। তারপর দুজন একত্রে অনেক সাংগঠনিক জেলায় গিয়েছিলাম; বক্তৃতাও করেছিলাম। একটি রিক্যুইজিশন কাউন্সিল আহ্বান করার যে উদ্যোগ আমাদের পক্ষ থেকে নেয়ার কথা ছিল সেটা বাকি ভাই, ওবায়েদ ভাই, এনায়েত ভাইয়েরা সবই মিলে বাতিল করে দিলেন। যদিও খুবই অনুল্লেখযোগ্য সংখ্যকের একটি উপদল বাংলার ছাত্রলীগ নামে একটি পরিসর ঘোষণা করে কিন্তু সেটা সংগঠনে তো প্রভাব বিস্তার করতে পারেইনি, তার আয়ুষ্কালও ছিল স্বল্প মেয়াদের। সেপ্টেম্বরে সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের বিরাট মাঠটিতে বিশাল প্যান্ডেলে যে সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয় তা উদ্বোধন করেন বঙ্গবন্ধু। কাউন্সিলে উপস্থিত সকল নেতৃবৃন্দ, কাউন্সিলর, ডেলিগেট আমাকে সভাপতি করার অটল সিদ্ধান্ত স্ব-স্ব জেলা থেকে গ্রহণ করে এসেছিলেন। সারা উত্তরবঙ্গেই একটা নিগূঢ় ঐক্যের অদৃশ্য বন্ধনে যেন সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। সেই খুলনা থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত সারা উত্তরবঙ্গ প্রচণ্ডভাবে উচ্ছ্বসিত ছিল। যথারীতি সম্মেলন চলছে, সাধারণ সম্পাদকদের রিপোর্টগুলো পর্যায়ক্রমে পঠিত হয়েছে। সাংগঠনিক অধিবেশনের প্রথম উদ্বোধনী অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু প্রধান অতিথির ভাষণ দেন আর তার আগে ছাত্রলীগের তৎকালীন সাবেক নেতৃবৃন্দ সংক্ষেপে ওই সম্মেলনের সফলতা কামনা করে বক্তৃতা করেন। এইভাবে পর্যায়ক্রমে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত সম্মেলনের ফাঁকে ফাঁকে জেলা নেতৃবৃন্দ কেউ প্যান্ডেলের ভেতরে; কেউবা জহুরুল হক হলের বিভিন্ন অঙ্গনে খণ্ড খণ্ডভাবে জড়ো হয়ে আলাপ করছিলেন। মূলত পরবর্তী প্যানেল তৈরির আলোচনা মুখ্য বিষয়বস্তু ছিল। আমি সম্ভবত কাউন্সিল ডেলিগেটদের আবাসনের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলাম। সংগঠনের সামগ্রিক প্রচেষ্টায় বিভিন্ন হলে, হোটেলে এবং মতিঝিলের ইডেন হোটেলে প্রায় তিনটি ফ্লোরে ডেলিগেট কাউন্সিলরদের সুশৃঙ্খল আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়। ফলে আমার নিঃশ্বাস ফেলার কোনো ফুরসত ছিল না। সংগঠন ও দায়িত্ব পালন সব সময় আমার কাছে নেশার মতো ছিল। তবুও আমাদের গ্রুপের প্রাক্তন ও তৎকালীন নেতৃবৃন্দ প্যানেল তৈরির কাজেও মনোযোগী ছিলেন। সম্ভাব্য নেতৃবর্গের পদায়নের ব্যাপারে আমি যদিও পরিষ্কার ছিলাম তবুও তৎকালীন আমাদের সাবেক নেতা ও সমকালীন নেতা আলোচনা পর্যালোচনার মধ্যদিয়ে সম্ভাব্য প্যানেলটি তৈরি করার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। সেদিন রাতেই কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের জন্য জহুরুল হক ক্যাফেটরিয়ায় বর্ধিত সভা শুরু হয়েছিল তখন ক্যাফেটরিয়ার আশপাশে আমি কারো সঙ্গে আলাপরত ছিলাম। তোফায়েল আহমেদ আমাকে ডেকে বললেন, চলেন আশপাশে কোথা থেকে চা খেতে খেতে দুজনে নির্জনে একটু মন খুলে আলাপ করি। অনবদ্য ঘনিষ্ঠতা না থাকলেও আমাদের মধ্যে ভালোই বন্ধুত্ব ছিল। আমিও প্রস্তাবে সানন্দে রাজি হলাম। বুদ্ধির চাতুর্যে তোফায়েল সাহেব আমার চেয়ে অনেক শীর্ষে ছিলেন- এ ব্যাপারে আমি অপরিপক্ব তো বটেই আবাল বললেও ভুল হবে না। আমি সানন্দচিত্তে তোফায়েল আহমদের জন্য নির্ধারিত গাড়িতে ওঠে বসলাম। গাড়িটি নীলক্ষেত হয়ে একটানে ৩২ নম্বর ধানমন্ডিতে পৌঁছে গেল। আমি কিছু বোঝার আগেই উনি আমাকে টেনে নিয়ে দোতলাই পৌঁছালে বুঝলাম বঙ্গবন্ধু আমাদের জন্যই অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি আমাদের দুজনকে একসঙ্গে দেখে খুবই খুশি হলেন। প্রসন্নচিত্তে আমাদের সম্বোধন করে তিনি আমাকে বললেন, তোমাদের সঙ্গে সংগঠনের প্রশ্নে আমার অত্যন্ত জরুরি আলাপ আছে। উনার পরনে লুঙ্গি ও সাদা পাঞ্জাবি ছিল। হাতে ধরা ছিল ধূমপানের প্রিয় পাইপটি। তিনি যথারীতি ধূমপানের পাইপটিতে দু-তিনটি টানও দিলেন। এখানে উল্লেখ করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না যে, তার চেহারাটা এতোই আকর্ষণীয় ও জ্বাজল্যমান ছিল যে তখনকার ইংরেজি ছবির নায়ক পিটার টেলি, স্টিফেন ভয়েড, ওমর শরীফ, গ্রেগরি পেক, রিচার্ড হ্যারিস প্রমুখ নায়কদের মতোই। জীবনে সিনেমায় অভিনয় না করলেও বলতে আমার দ্বিধা নেই রাজনীতির মতো ওই ক্ষেত্রেও কাজ করলে তিনি প্রতিথযশা হতে পারতেন। তিনি চেহারায় একটা গাম্ভীর্যের ভাব এনে আমার হাতে দুই পৃষ্ঠার কাগজ ধরিয়ে দিলেন। আমি তড়িৎগতিতে পৃষ্ঠা দুটির ওপর চোখ বুলিয়ে দেখলাম যে, ওটা ছিল নবগঠিত ছাত্রলীগের প্রস্তাবিত প্যানেল। আমি আড় চোখে দেখে নিলাম। আমি যখন প্যানেল পড়ছিলাম তখন মুজিব ভাই নির্বিকারভাবে পাইপ দিয়ে ধূমপান করছিলেন এবং তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে আমার প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করছিলেন। যদিও প্যানেলে সভাপতি হিসেবে আমার নাম রাখা হয়েছে তবুও আমাদের প্রতিথযশা ছাত্রনেতাদেরসহ আমাদের সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশেরও কম। আমার হৃৎকম্প শুরু হয়েছে। আমি নিশ্চিত প্যানেলটি সিরাজুল আলম খানেরই প্রস্তুত করা ছিল। আর এটি শেখ ফজলুল হক মণি, আবদুর রাজ্জাক এবং তোফায়েল আহমদের মদদপুষ্ট ছিল। প্যানেলটিকে স্বাভাবিকচিত্তে নেয়ার প্রশ্নই ছিল না। ওটা যেন আমার মৃত্যু পরোয়ানা ছিল। তবুও বিক্ষোভে ফেটে না পড়ে শান্ত বিনম্র কণ্ঠে মুজিব ভাইকে বলেছিলাম এই প্যানেল আমার পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব নয়। আপনি দয়া করে সভাপতির পদ থেকে আমার নামটি বাদ দিয়ে দিন। প্রয়োজনে আমি আজই আওয়ামী লীগে যোগ দেব এবং আপনি চাইলে আমি সত্তরের নির্বাচনে আমার এলাকা থেকে প্রার্থীও হবো। আমি নিশ্চিত ছিলাম ভোলা থেকে তোফায়েল আহমেদ জাতীয় পরিষদে প্রার্থী হবেন।
মুজিব ভাই আমার ওপর ভীষণ রেগে গেলেন। তিনি উচ্চৈঃস্বরে বললেন, আমার প্রতি তোমার আনুগত্যের প্রশ্নে কোন দ্বিধা সংশয় নেই। কিন্তু তোমার যারা মুরুব্বি যাদের কথায় তুমি প্রভাবান্বিত হও তাদের অনেকেই শেখ মুজিবের প্রশ্নে নিসংশয় চিত্ত নয়। আমি অবগত, এটার পরোয়া করি না। কিন্তু তুমি জানো তোমার প্রতি আমার স্নেহের গভীরতা কতটুকু। তা সত্ত্বেও তুমি যদি তাদের দ্বারাই প্রভাবান্বিত হতে থাকো, তাহলে আমাকে ভুলে যেতে হবে। ইংরেজিতে বললেন, যিধঃ ফড় ুড়ঁ ধিহঃ? সব ড়ৎ ংঃঁফবহঃ ষবধমঁব ঢ়ধহবষ? ণড়ঁ ধৎব পযড়ড়ংব ধহু ড়ভ ঃযব ঃড়ি? ঝরফফরয়ঁব বহড়ঁময রং বহড়ঁময. ঞৎু-হড়ঃ ঃড় বীঢ়ষড়রঃ সু ধভভবপঃরড়হ ভড়ৎ ুড়ঁ. ঊরঃযবৎ ুড়ঁ ধৎব ঃড় ধপপবঢ়ঃ ঃযরং ঢ়ধহবষ ড়ৎ ুড়ঁ ধৎব ঃড় ভড়ৎমবঃ সব ভড়ৎবাবৎ. আমার এতো গ্যাঞ্জাম ভালো লাগে না। মুজিবুর রহমান কাউরে ট্যাকসো দিয়ে রাজনীতি করে না। আমার জন্য সেই মুহূর্তটি কতখানি সংকটের তা বলে বোঝানো যাবে না। তবুও প্রচণ্ড বেয়াদবি করে আমি প্যানেলটি গ্রহণ করিনি। তিনি ওখানে উপস্থিত থাকা রাজ্জাক ভাইয়ের হাতে প্যানেলটি দিয়ে বললেন, তুমি কাউন্সিলে ভোরের দিকে প্যানেলটি পড়ে দিবা। কথামতো কাজ হয়েছিল সিরাজুল আলম খান ভাইয়ের গ্রুপটি দুই-তৃতীয়াংশ পাওয়া স্বপ্নাতীত অর্জনের পরও চাপ সৃষ্টির কৌশল হিসেবে পরের দিন তারা খণ্ড খণ্ড মিছিল করেন এবং ঘোষিত প্যানেল থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। আমরা তাৎক্ষণিকভাবে মুজিব ভাইয়ের কাছে ছুটে যাই বিষয়টি অবহিত করি এবং তিনিও ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, ঠিক আছে তাদের পদত্যাগ গ্রহণ করা হবে- মড় ধহফ মরাব ুড়ঁৎ ঢ়ধহবষ. আমরা তো খুশিতে আত্মহারা কিন্তু বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো কোথা থেকে উনার টেলিফোনে কল এলো। তিনি ঘরের ভেতরে গিয়ে টেলিফোনে কথা বলে প্রফুল্ল চিত্তে বাইরে এসে বললেন, আমার সঙ্গে সিরাজুল আলমের কথা হয়েছে ওরা পদত্যাগ করবে না, সব ঝামেলা কেটে গেল। আমরা ভাবলাম, ঝামেলাতো কাটলোই না বরং জগদ্দল পাথরের মতো ঝামেলা সংগঠনের ওপর চেপে বসলো। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে এক-তৃতীয়াংশ সদস্য নিয়ে কাজ করা সে কি দুঃসাধ্য ছিল তা বোঝানো যাবে না। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে রেসকোর্স ও পল্টন ময়দানে দুটি পৃথক সম্মেলনে সংগঠন বিভক্ততো হলোই অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধকালে মুজিব বাহিনীর আড়ালে জাসদের সশস্ত্র ক্যাডার গণবাহিনী সংগঠিত হয়েছে। আমি এখানে পুনরুল্লেখ করতে চাই, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীদের এমনকি আমাদেরও অনেকে বিশ্বাস করতেন বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান থেকে জীবন নিয়ে ফিরবেন না। ফলে তার অবর্তমানে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার সব প্রস্তুতি তারা গ্রহণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু ফেরার প্রশ্নে আমার অটুট বিশ্বাস এবং আল্লাহর রহমানের প্রতি আমার নিগূঢ় আস্থার ওপর নির্ভর করে আমি চলতে লাগলাম। বঙ্গবন্ধুর ছাত্রলীগের প্রশ্নে নানাবিধ দ্বিধা সংকোচ অবলোকন করে আমার মনে সংশয়টা এতখানি প্রকট হয় যে, রেসকোর্স ময়দানে আমার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে প্রধান অতিথির ভাষণ প্রদানকালেও আমি সংশয়চিত্তে বারবার মণি ভাই রাজ্জাক ভাইকে প্রশ্ন করছিলাম, মুজিব ভাই আবার পল্টনে ছাত্রলীগের আরেকটি সম্মেলন হচ্ছিল সেখানে চলে যাবেন না তো? বক্তৃতার একটি পর্যায়ে নেতা বললেন, ‘আমি বাংলার শেখ মুজিব, আমার নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আমি কমরেড টমরেড নই। তিনি আরও বলেছিলেন, আমি শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা চাই। মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি আমার অঙ্গীকার। কিন্তু বিদেশ থেকে ধার করা সমাজতন্ত্র আমি প্রতিষ্ঠা করবো না। তবুও ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয়ের মতো আমি ভেতরে ভেতরে সন্ত্রস্ত ছিলাম। পাছে তিনি আবার পল্টন ময়দানে চলে না যান। হঠাৎ শুনতে পেলাম কে বা কারা যেন পল্টনে অনুষ্ঠিত আরেকটি সম্মেলনের প্যান্ডেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। পল্টনে অনুষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীদের সম্মেলনেও বঙ্গবন্ধুর বিশাল পোর্টেট এবং তার বাণী সম্বলিত অগণিত ফেস্টুন টাঙানো হয়েছিল। সেগুলো পুড়ে ভষ্মীভূত হচ্ছে।
এটি ছিল কৌশল। বঙ্গবন্ধু দোতলায় আমাদের অপেক্ষায়। আমাদের দেখে তিনি চেহারায় গাম্ভীর্যের ভাব এনে আমার হাতে দুই পৃষ্ঠার কাগজ ধরিয়ে দিলেন। আড়চোখে তাকিয়ে দেখি এটি নবগঠিত ছাত্রলীগের প্রস্তাবিত প্যানেল। ঘটনাক্রম এভাবেই এগিয়ে যায় চূড়ান্ত পরিণতির দিকে। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক নূরে আলম সিদ্দিকীর ধারাবাহিক সাক্ষাৎকারের আজ পড়ুন ১৯তম কিস্তি:
ঠিক হলো সেপ্টেম্বরের দিকে আরেকটি সম্মেলন হবে অনেক জাঁকজমকভাবে তবে ভুল বোঝাবুঝি নিরসনের জন্য ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে নেতা ও কর্মীরা সমবেত হবেন যেখানে তোফায়েল আহমদ ও আমি একসঙ্গে বক্তৃতা করবো। আমি এমনিতেই আবেগতাড়িত লোক এই সুযোগটি আমাকে আপ্লুত করে; উদ্বেলিত করে। আমি মনঃস্থির করি, সম্মেলনে আমি বুদ্ধি উজাড় করে অনুভূতির সমস্ত আবির মাখিয়ে বক্তৃতা করবো। উদগত, উদ্বত, উদ্বত্য পূর্ণায়ত পদ্মটির মতো নিজেকে মেলে ধরবো। করেছিলাম-ও তাই। আবেগে মায়ের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে প্যারোল না পাওয়ার ঘটনা থেকে শুরু করে ছাত্রলীগের জন্য আমার হৃদয়ের পুঞ্জীভূত ভালোবাসার সব উপমাগুলোকে মর্মস্পর্শী ভাষায় সাজিয়ে, চোখের জলে বুক ভাসিয়ে এক ঘণ্টার ওপরে করা বক্তৃতাটি এতই আবেগ-উচ্ছ্বাসের সৃষ্টি করে যে আমি শতভাগ নিশ্চয়তার সঙ্গে বলতে পারি পরবর্তীকালে ছাত্রলীগের সভাপতি হওয়ার প্রশ্নটি এখানেই স্থির হয়ে যায়। বাংলা ছাত্রলীগ গঠনের যে অপবাদটি আমার নামে ছড়ানো হয়েছিল তার পুঙ্খানুপুঙ্খ জবাব দিয়ে আমি বলেছিলাম, ‘কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিবে যে, সে পূর্বে মরে নাই।’ মুজিব ভাই তার গৃহে উপস্থিত সব নেতৃত্বকে পরামর্শ দিলেন তোফায়েল ও আলম একসঙ্গে সাংগঠনিক সফর করে বেড়াতে যাতে ভুল বোঝাবুঝির সব অবকাশ শেষ হয়ে যায়। এ উদ্দেশ্যে প্রথম সম্মেলন নারায়ণগঞ্জে আহূত হয়। সেখানকার বালুর মাঠে অনেকের সঙ্গে তোফায়েল আহমদ ও আমি বক্তৃতা করি। তারপর দুজন একত্রে অনেক সাংগঠনিক জেলায় গিয়েছিলাম; বক্তৃতাও করেছিলাম। একটি রিক্যুইজিশন কাউন্সিল আহ্বান করার যে উদ্যোগ আমাদের পক্ষ থেকে নেয়ার কথা ছিল সেটা বাকি ভাই, ওবায়েদ ভাই, এনায়েত ভাইয়েরা সবই মিলে বাতিল করে দিলেন। যদিও খুবই অনুল্লেখযোগ্য সংখ্যকের একটি উপদল বাংলার ছাত্রলীগ নামে একটি পরিসর ঘোষণা করে কিন্তু সেটা সংগঠনে তো প্রভাব বিস্তার করতে পারেইনি, তার আয়ুষ্কালও ছিল স্বল্প মেয়াদের। সেপ্টেম্বরে সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের বিরাট মাঠটিতে বিশাল প্যান্ডেলে যে সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয় তা উদ্বোধন করেন বঙ্গবন্ধু। কাউন্সিলে উপস্থিত সকল নেতৃবৃন্দ, কাউন্সিলর, ডেলিগেট আমাকে সভাপতি করার অটল সিদ্ধান্ত স্ব-স্ব জেলা থেকে গ্রহণ করে এসেছিলেন। সারা উত্তরবঙ্গেই একটা নিগূঢ় ঐক্যের অদৃশ্য বন্ধনে যেন সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। সেই খুলনা থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত সারা উত্তরবঙ্গ প্রচণ্ডভাবে উচ্ছ্বসিত ছিল। যথারীতি সম্মেলন চলছে, সাধারণ সম্পাদকদের রিপোর্টগুলো পর্যায়ক্রমে পঠিত হয়েছে। সাংগঠনিক অধিবেশনের প্রথম উদ্বোধনী অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু প্রধান অতিথির ভাষণ দেন আর তার আগে ছাত্রলীগের তৎকালীন সাবেক নেতৃবৃন্দ সংক্ষেপে ওই সম্মেলনের সফলতা কামনা করে বক্তৃতা করেন। এইভাবে পর্যায়ক্রমে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত সম্মেলনের ফাঁকে ফাঁকে জেলা নেতৃবৃন্দ কেউ প্যান্ডেলের ভেতরে; কেউবা জহুরুল হক হলের বিভিন্ন অঙ্গনে খণ্ড খণ্ডভাবে জড়ো হয়ে আলাপ করছিলেন। মূলত পরবর্তী প্যানেল তৈরির আলোচনা মুখ্য বিষয়বস্তু ছিল। আমি সম্ভবত কাউন্সিল ডেলিগেটদের আবাসনের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলাম। সংগঠনের সামগ্রিক প্রচেষ্টায় বিভিন্ন হলে, হোটেলে এবং মতিঝিলের ইডেন হোটেলে প্রায় তিনটি ফ্লোরে ডেলিগেট কাউন্সিলরদের সুশৃঙ্খল আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়। ফলে আমার নিঃশ্বাস ফেলার কোনো ফুরসত ছিল না। সংগঠন ও দায়িত্ব পালন সব সময় আমার কাছে নেশার মতো ছিল। তবুও আমাদের গ্রুপের প্রাক্তন ও তৎকালীন নেতৃবৃন্দ প্যানেল তৈরির কাজেও মনোযোগী ছিলেন। সম্ভাব্য নেতৃবর্গের পদায়নের ব্যাপারে আমি যদিও পরিষ্কার ছিলাম তবুও তৎকালীন আমাদের সাবেক নেতা ও সমকালীন নেতা আলোচনা পর্যালোচনার মধ্যদিয়ে সম্ভাব্য প্যানেলটি তৈরি করার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। সেদিন রাতেই কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের জন্য জহুরুল হক ক্যাফেটরিয়ায় বর্ধিত সভা শুরু হয়েছিল তখন ক্যাফেটরিয়ার আশপাশে আমি কারো সঙ্গে আলাপরত ছিলাম। তোফায়েল আহমেদ আমাকে ডেকে বললেন, চলেন আশপাশে কোথা থেকে চা খেতে খেতে দুজনে নির্জনে একটু মন খুলে আলাপ করি। অনবদ্য ঘনিষ্ঠতা না থাকলেও আমাদের মধ্যে ভালোই বন্ধুত্ব ছিল। আমিও প্রস্তাবে সানন্দে রাজি হলাম। বুদ্ধির চাতুর্যে তোফায়েল সাহেব আমার চেয়ে অনেক শীর্ষে ছিলেন- এ ব্যাপারে আমি অপরিপক্ব তো বটেই আবাল বললেও ভুল হবে না। আমি সানন্দচিত্তে তোফায়েল আহমদের জন্য নির্ধারিত গাড়িতে ওঠে বসলাম। গাড়িটি নীলক্ষেত হয়ে একটানে ৩২ নম্বর ধানমন্ডিতে পৌঁছে গেল। আমি কিছু বোঝার আগেই উনি আমাকে টেনে নিয়ে দোতলাই পৌঁছালে বুঝলাম বঙ্গবন্ধু আমাদের জন্যই অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি আমাদের দুজনকে একসঙ্গে দেখে খুবই খুশি হলেন। প্রসন্নচিত্তে আমাদের সম্বোধন করে তিনি আমাকে বললেন, তোমাদের সঙ্গে সংগঠনের প্রশ্নে আমার অত্যন্ত জরুরি আলাপ আছে। উনার পরনে লুঙ্গি ও সাদা পাঞ্জাবি ছিল। হাতে ধরা ছিল ধূমপানের প্রিয় পাইপটি। তিনি যথারীতি ধূমপানের পাইপটিতে দু-তিনটি টানও দিলেন। এখানে উল্লেখ করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না যে, তার চেহারাটা এতোই আকর্ষণীয় ও জ্বাজল্যমান ছিল যে তখনকার ইংরেজি ছবির নায়ক পিটার টেলি, স্টিফেন ভয়েড, ওমর শরীফ, গ্রেগরি পেক, রিচার্ড হ্যারিস প্রমুখ নায়কদের মতোই। জীবনে সিনেমায় অভিনয় না করলেও বলতে আমার দ্বিধা নেই রাজনীতির মতো ওই ক্ষেত্রেও কাজ করলে তিনি প্রতিথযশা হতে পারতেন। তিনি চেহারায় একটা গাম্ভীর্যের ভাব এনে আমার হাতে দুই পৃষ্ঠার কাগজ ধরিয়ে দিলেন। আমি তড়িৎগতিতে পৃষ্ঠা দুটির ওপর চোখ বুলিয়ে দেখলাম যে, ওটা ছিল নবগঠিত ছাত্রলীগের প্রস্তাবিত প্যানেল। আমি আড় চোখে দেখে নিলাম। আমি যখন প্যানেল পড়ছিলাম তখন মুজিব ভাই নির্বিকারভাবে পাইপ দিয়ে ধূমপান করছিলেন এবং তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে আমার প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করছিলেন। যদিও প্যানেলে সভাপতি হিসেবে আমার নাম রাখা হয়েছে তবুও আমাদের প্রতিথযশা ছাত্রনেতাদেরসহ আমাদের সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশেরও কম। আমার হৃৎকম্প শুরু হয়েছে। আমি নিশ্চিত প্যানেলটি সিরাজুল আলম খানেরই প্রস্তুত করা ছিল। আর এটি শেখ ফজলুল হক মণি, আবদুর রাজ্জাক এবং তোফায়েল আহমদের মদদপুষ্ট ছিল। প্যানেলটিকে স্বাভাবিকচিত্তে নেয়ার প্রশ্নই ছিল না। ওটা যেন আমার মৃত্যু পরোয়ানা ছিল। তবুও বিক্ষোভে ফেটে না পড়ে শান্ত বিনম্র কণ্ঠে মুজিব ভাইকে বলেছিলাম এই প্যানেল আমার পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব নয়। আপনি দয়া করে সভাপতির পদ থেকে আমার নামটি বাদ দিয়ে দিন। প্রয়োজনে আমি আজই আওয়ামী লীগে যোগ দেব এবং আপনি চাইলে আমি সত্তরের নির্বাচনে আমার এলাকা থেকে প্রার্থীও হবো। আমি নিশ্চিত ছিলাম ভোলা থেকে তোফায়েল আহমেদ জাতীয় পরিষদে প্রার্থী হবেন।
মুজিব ভাই আমার ওপর ভীষণ রেগে গেলেন। তিনি উচ্চৈঃস্বরে বললেন, আমার প্রতি তোমার আনুগত্যের প্রশ্নে কোন দ্বিধা সংশয় নেই। কিন্তু তোমার যারা মুরুব্বি যাদের কথায় তুমি প্রভাবান্বিত হও তাদের অনেকেই শেখ মুজিবের প্রশ্নে নিসংশয় চিত্ত নয়। আমি অবগত, এটার পরোয়া করি না। কিন্তু তুমি জানো তোমার প্রতি আমার স্নেহের গভীরতা কতটুকু। তা সত্ত্বেও তুমি যদি তাদের দ্বারাই প্রভাবান্বিত হতে থাকো, তাহলে আমাকে ভুলে যেতে হবে। ইংরেজিতে বললেন, যিধঃ ফড় ুড়ঁ ধিহঃ? সব ড়ৎ ংঃঁফবহঃ ষবধমঁব ঢ়ধহবষ? ণড়ঁ ধৎব পযড়ড়ংব ধহু ড়ভ ঃযব ঃড়ি? ঝরফফরয়ঁব বহড়ঁময রং বহড়ঁময. ঞৎু-হড়ঃ ঃড় বীঢ়ষড়রঃ সু ধভভবপঃরড়হ ভড়ৎ ুড়ঁ. ঊরঃযবৎ ুড়ঁ ধৎব ঃড় ধপপবঢ়ঃ ঃযরং ঢ়ধহবষ ড়ৎ ুড়ঁ ধৎব ঃড় ভড়ৎমবঃ সব ভড়ৎবাবৎ. আমার এতো গ্যাঞ্জাম ভালো লাগে না। মুজিবুর রহমান কাউরে ট্যাকসো দিয়ে রাজনীতি করে না। আমার জন্য সেই মুহূর্তটি কতখানি সংকটের তা বলে বোঝানো যাবে না। তবুও প্রচণ্ড বেয়াদবি করে আমি প্যানেলটি গ্রহণ করিনি। তিনি ওখানে উপস্থিত থাকা রাজ্জাক ভাইয়ের হাতে প্যানেলটি দিয়ে বললেন, তুমি কাউন্সিলে ভোরের দিকে প্যানেলটি পড়ে দিবা। কথামতো কাজ হয়েছিল সিরাজুল আলম খান ভাইয়ের গ্রুপটি দুই-তৃতীয়াংশ পাওয়া স্বপ্নাতীত অর্জনের পরও চাপ সৃষ্টির কৌশল হিসেবে পরের দিন তারা খণ্ড খণ্ড মিছিল করেন এবং ঘোষিত প্যানেল থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। আমরা তাৎক্ষণিকভাবে মুজিব ভাইয়ের কাছে ছুটে যাই বিষয়টি অবহিত করি এবং তিনিও ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, ঠিক আছে তাদের পদত্যাগ গ্রহণ করা হবে- মড় ধহফ মরাব ুড়ঁৎ ঢ়ধহবষ. আমরা তো খুশিতে আত্মহারা কিন্তু বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো কোথা থেকে উনার টেলিফোনে কল এলো। তিনি ঘরের ভেতরে গিয়ে টেলিফোনে কথা বলে প্রফুল্ল চিত্তে বাইরে এসে বললেন, আমার সঙ্গে সিরাজুল আলমের কথা হয়েছে ওরা পদত্যাগ করবে না, সব ঝামেলা কেটে গেল। আমরা ভাবলাম, ঝামেলাতো কাটলোই না বরং জগদ্দল পাথরের মতো ঝামেলা সংগঠনের ওপর চেপে বসলো। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে এক-তৃতীয়াংশ সদস্য নিয়ে কাজ করা সে কি দুঃসাধ্য ছিল তা বোঝানো যাবে না। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে রেসকোর্স ও পল্টন ময়দানে দুটি পৃথক সম্মেলনে সংগঠন বিভক্ততো হলোই অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধকালে মুজিব বাহিনীর আড়ালে জাসদের সশস্ত্র ক্যাডার গণবাহিনী সংগঠিত হয়েছে। আমি এখানে পুনরুল্লেখ করতে চাই, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীদের এমনকি আমাদেরও অনেকে বিশ্বাস করতেন বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান থেকে জীবন নিয়ে ফিরবেন না। ফলে তার অবর্তমানে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার সব প্রস্তুতি তারা গ্রহণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু ফেরার প্রশ্নে আমার অটুট বিশ্বাস এবং আল্লাহর রহমানের প্রতি আমার নিগূঢ় আস্থার ওপর নির্ভর করে আমি চলতে লাগলাম। বঙ্গবন্ধুর ছাত্রলীগের প্রশ্নে নানাবিধ দ্বিধা সংকোচ অবলোকন করে আমার মনে সংশয়টা এতখানি প্রকট হয় যে, রেসকোর্স ময়দানে আমার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে প্রধান অতিথির ভাষণ প্রদানকালেও আমি সংশয়চিত্তে বারবার মণি ভাই রাজ্জাক ভাইকে প্রশ্ন করছিলাম, মুজিব ভাই আবার পল্টনে ছাত্রলীগের আরেকটি সম্মেলন হচ্ছিল সেখানে চলে যাবেন না তো? বক্তৃতার একটি পর্যায়ে নেতা বললেন, ‘আমি বাংলার শেখ মুজিব, আমার নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আমি কমরেড টমরেড নই। তিনি আরও বলেছিলেন, আমি শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা চাই। মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি আমার অঙ্গীকার। কিন্তু বিদেশ থেকে ধার করা সমাজতন্ত্র আমি প্রতিষ্ঠা করবো না। তবুও ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয়ের মতো আমি ভেতরে ভেতরে সন্ত্রস্ত ছিলাম। পাছে তিনি আবার পল্টন ময়দানে চলে না যান। হঠাৎ শুনতে পেলাম কে বা কারা যেন পল্টনে অনুষ্ঠিত আরেকটি সম্মেলনের প্যান্ডেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। পল্টনে অনুষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীদের সম্মেলনেও বঙ্গবন্ধুর বিশাল পোর্টেট এবং তার বাণী সম্বলিত অগণিত ফেস্টুন টাঙানো হয়েছিল। সেগুলো পুড়ে ভষ্মীভূত হচ্ছে।