মত-মতান্তর
একাত্তর: আগে-পরে(১৭)
সংবাদটি আমাকেও শোকে মুহ্যমান করে ফেলে
৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, শুক্রবার, ১:৩৬ পূর্বাহ্ন
শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী কোনো সাধারণ রাজনীতিক ছিলেন না। পারিবারিক ঐতিহ্য ও শিক্ষা ইন্দিরা গান্ধীকে ধীরে ধীরে একজন আপাদমস্তক রাজনীতিকে পরিণত করে। She was a Tailor made statesman. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইন্দিরা গান্ধী একের পর এক কূটনৈতিক কৌশলে মুক্তি বাহিনীর পাশে দাঁড়ান। বিশ্বব্যাপী গণহত্যার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলেন। সেইসব ঘটনার সাক্ষী নূরে আলম সিদ্দিকীর বয়ানে আজ পড়ুন ১৭তম কিস্তি: নিয়াজীর আত্মসমর্পণের কথা
শোনার সঙ্গে সঙ্গে ১৬ই ডিসেম্বর থিয়েটার রোডে সিদ্ধান্ত হয় ঐদিন ভারতীয় সামরিক হেলিকপ্টারে শাজাহান সিরাজ ও আমি ঢাকায় এসে পড়বো। ১৭ই ডিসেম্বর অপরাহ্ণে ঢাকায় পৌঁছে আমার জীবনের সবচাইতে গর্বিত আনন্দঘন মুহূর্তটি উপভোগ করি। বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরে লক্ষ লক্ষ মানুষের ভালোবাসার আবীর মাখানো সেই দৃশ্য অবলোকনের উদ্বেলিত ও গর্বিত চিত্তের অনুভূতিটা অবর্ণনীয়। সকল মানুষের ভাগ্যে মুক্তিযুদ্ধ আসে না এবং তার বিজয় অবলোকন করার হৃদয়ের পরতে পরতে বিজয়ের স্বাদ গ্রহণ করার সৌভাগ্য হয় না যেটা আমাদের হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ১০ই জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বিমানবন্দরে তাকে বিরোচিত সংবর্ধনা দিয়ে রেসকোর্সের মঞ্চে তাকে নিয়ে গেলে অশ্রুসিক্ত নয়নে তিনি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় ও বাংলার মানুষের কাছে এবং বিশেষ করে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ও ভারতের জনগণের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এটা অকল্পনীয় বিষয় হলো ঐ সভা থেকেই তিনি দাবি করেন নির্ধারিত দিবসের পূর্বেই বাংলার মাটি থেকে ভারতীয় সৈন্যদের প্রত্যাহার করে নেয়া। নির্ধারিত শব্দটি ব্যবহারে অনুধাবন করা যায় দিল্লিতে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে একান্ত বৈঠকে বিষয়টি আলোচিত হয়েছিল ও সৈন্য প্রত্যাহারে একটি তারিখও ধার্য হয়েছিল। কিন্তু রেসকোর্স ময়দান থেকে নির্ধারিত সময়ের পূর্বে কথাটি উচ্চারণ করে তিনি সময়টি আরো এগিয়ে নিয়ে এলেন। তিনি জানতেন বিজয়ী সৈন্যরা বিজিত দেশে একবার জেঁকে বসলে তাদেরকে প্রত্যাহার অনেক সময় দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সফরে এলে তাকে বীরোচিত সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। বঙ্গবন্ধু তার বক্তৃতায় বলেন, আপনি মতিলাল নেহেরুর দৌহিত্র জওহর লাল নেহেরুর কন্যা। আপনার কাছে আমার দাবি নির্ধারিত দিবসের পূর্বেই আপনি বাংলার মাটি থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবেন। অবশ্য শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ঐ সভায় তার প্রদত্ত ভাষণে প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর দেননি। তবে পৃথিবীর ইতিহাসের বিরল দৃষ্টান্ত হিসেবে স্বল্প সময়ের মধ্যেই ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়ে যান। তার কূটনৈতিক কৌশলের আরেকটি গৌরবজনক দিক হলো মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তার বিশ্ব সফরকালীন সময়ে তিনি অঙ্গীকার করেছিলেন একটি পাকিস্তানি সৈন্যকেও যুদ্ধবন্দি করা হবে না। পূর্ব পাকিস্তানে একটি অবাঙালিকেও হত্যা করা হবে না। ছিয়ানব্বই হাজার পাকিস্তানি সৈন্যকে ভারতে নিয়ে গিয়ে সযত্নে তাদেরকে পাকিস্তানে ফিরিয়ে দিয়ে তিনি তার সেই ওয়াদাকে রক্ষা করেছিলেন। ফলে সারাবিশ্বে তার ভাবমূর্তি ভিন্নতর উচ্চতায় পৌঁছে যায়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের সকল মানুষের বিদগ্ধ চিত্তের নেত্রী হয়ে ওঠেন-ভারতেও প্রধানমন্ত্রী হতে কালজয়ী স্টেটসম্যানে পরিণত হন। তিনি যখন বাংলাদেশে আসেন তখন আমাদের চারজনের জন্য অতি সুন্দর চারটি সিগারেট কেস উপহার হিসেবে নিয়ে আসেন। যার ভেতরে একটি সুন্দর মনোরম কার্ডে ইংরেজিতে লেখা ছিল শুভেচ্ছাসহ শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। উপহারটি আনুষ্ঠানিকভাবে দেয়ার কথা ছিল। সেই আনুষ্ঠানিকতাটি হতে দেয়া হয়নি বিধায় ভারতীয় কূটনীতিকের মাধ্যমে আমাদের কাছে উপহারটি পৌঁছায়। তার মধ্যে আমার প্রাপ্য এ উপহারটি আজও অতি সযত্নে রক্ষিত আছে আমার কাছে। তাকে নিয়ে আরেকটি মজার স্মৃতি হলো বঙ্গভবনে তার সম্মানে প্রদত্ত নৈশভোজে শীর্ষ টেবিলে যেখানে তিনি এবং বঙ্গবন্ধু বসবেন তার সঙ্গে কোনাকুনি করে আমাদের টেবিলটি রাখা হয়েছিল এর মধ্যে শাজাহান সিরাজ ও আমি সস্ত্রীক ছিলাম। ছয়জনের গোলটেবিলে বসেই আমরা চারজন সিদ্ধান্ত নিলাম ছুরি-কাঁটা বর্জন করে আমরা হাত দিয়ে খাবো। কি অভূতপূর্ব অভাবনীয় ব্যাপার আমাদের হাত দিয়ে খাওয়া ত্বরিত লক্ষ্য করে তিনিও হাত দিয়ে খাওয়া শুরু করলেন। সমগ্র অতিথিবৃন্দ প্রচণ্ড হাস্যরোলে ফেটে পড়লেন। কিন্তু লক্ষ্য করে আমাদের বুঝতে কষ্ট হলো না হাত দিয়ে আহার গ্রহণ করতে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী অভ্যস্ত নন। আমরা লজ্জা পেলাম কিন্তু তখন তো আর কাঁটাচামচ, ছুরি দিয়ে পুনরায় শুরু করার সুযোগ ছিল না। এর আগে বিমানবন্দরে সারিবদ্ধ হয়ে দণ্ডায়মান অবস্থায় বঙ্গবন্ধু যখন তার সঙ্গে আমাদের চারজনের পরিচয় করিয়ে দেন তখন বিশেষ ভঙ্গিমায় স্মিথ হেসে তিনি আমাদের দিকে যেভাবে তাকান সেটাও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। আজও আমার মনে হয় ঝযব ধিং ধ ঃধরষড়ৎ সধফব ংঃধঃবংসধহ. সবকিছুই যেন নিখুঁত পরিপাটি করে সাজানো। রেসকোর্সে তার ভাষণের ভাষা ছিল হিন্দি। কিন্তু ভাষণে শব্দচয়ন এত সহজ ও সরল ছিল যে, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষেরও বুঝতে কষ্ট হয়নি। কি অদ্ভূত প্রাঞ্জল ও সুদূরপ্রসারী ছিল তার দৃষ্টিভঙ্গি। তার ভাষণের একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন অনেকদিনের শোষণ-বঞ্চনাকে ডিঙ্গিয়ে একটি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে রক্তস্নাত স্বাধীনতাকে আপনারা অর্জন করেছেন। এই অর্জনকে রক্ষা করতে হলে আপনাদেরকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। দেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার প্রচেষ্টায় সততা ও কঠিন পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। কথাটি শুধু বিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য নয় যুদ্ধে জরাজীর্ণ সকল দেশের জন্যই সর্বজনীনভাবে প্রযোজ্য। প্রাসঙ্গিকভাবে আমি এখানে উল্লেখ করতে চাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত ধ্বংসপ্রাপ্ত জার্মান ও জাপানের জনগণ পরিশ্রম, শৃঙ্খলা ও সততার মধ্য দিয়ে আজকে বিশ্বের বুকে যেরূপ গর্বিত মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে আমরা সেরূপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধকালীন চেতনা বিজয়ের পরে অনেকখানি ম্রিয়মাণ হয়ে যায়। প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার লোভ আমাদের অমলিন চিত্তকে অনেকখানি বিধ্বস্ত করে ফেলে। একদিকে স্বাধীনতা বিরোধীদের ষড়যন্ত্র অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের নিষ্কলুষ হৃদয় প্রাপ্তি-প্রত্যাশা-প্রলোভনের মেঘে আড়াল হতে থাকে। তবুও আমাদের অর্জন অনেক কিন্তু চিত্ত নির্মোহ থাকলে আমরা জার্মান ও জাপানের মতোই অর্জনে সাফল্যে গৌরবান্বিত থাকতে পারতাম।
ভারতের জন্য এটি হৃদয়বিদারক মর্মান্তিক অনভিপ্রেত যে, দেহরক্ষী কর্তৃক শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী নিহত হওয়া। বাংলাদেশের মানুষও এই মর্মান্তিক ঘটনায় দুঃসহ যন্ত্রণা অনুভব করেছে। সংবাদটি আমাকেও শোকে মুহ্যমান করে ফেলে। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়েছিল রক্তের কোনো সম্পর্ক না থাকলেও হৃদয়ের অতি নিকট মানুষটিকে আমরা হারিয়েছিলাম।
শোনার সঙ্গে সঙ্গে ১৬ই ডিসেম্বর থিয়েটার রোডে সিদ্ধান্ত হয় ঐদিন ভারতীয় সামরিক হেলিকপ্টারে শাজাহান সিরাজ ও আমি ঢাকায় এসে পড়বো। ১৭ই ডিসেম্বর অপরাহ্ণে ঢাকায় পৌঁছে আমার জীবনের সবচাইতে গর্বিত আনন্দঘন মুহূর্তটি উপভোগ করি। বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরে লক্ষ লক্ষ মানুষের ভালোবাসার আবীর মাখানো সেই দৃশ্য অবলোকনের উদ্বেলিত ও গর্বিত চিত্তের অনুভূতিটা অবর্ণনীয়। সকল মানুষের ভাগ্যে মুক্তিযুদ্ধ আসে না এবং তার বিজয় অবলোকন করার হৃদয়ের পরতে পরতে বিজয়ের স্বাদ গ্রহণ করার সৌভাগ্য হয় না যেটা আমাদের হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ১০ই জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বিমানবন্দরে তাকে বিরোচিত সংবর্ধনা দিয়ে রেসকোর্সের মঞ্চে তাকে নিয়ে গেলে অশ্রুসিক্ত নয়নে তিনি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় ও বাংলার মানুষের কাছে এবং বিশেষ করে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ও ভারতের জনগণের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এটা অকল্পনীয় বিষয় হলো ঐ সভা থেকেই তিনি দাবি করেন নির্ধারিত দিবসের পূর্বেই বাংলার মাটি থেকে ভারতীয় সৈন্যদের প্রত্যাহার করে নেয়া। নির্ধারিত শব্দটি ব্যবহারে অনুধাবন করা যায় দিল্লিতে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে একান্ত বৈঠকে বিষয়টি আলোচিত হয়েছিল ও সৈন্য প্রত্যাহারে একটি তারিখও ধার্য হয়েছিল। কিন্তু রেসকোর্স ময়দান থেকে নির্ধারিত সময়ের পূর্বে কথাটি উচ্চারণ করে তিনি সময়টি আরো এগিয়ে নিয়ে এলেন। তিনি জানতেন বিজয়ী সৈন্যরা বিজিত দেশে একবার জেঁকে বসলে তাদেরকে প্রত্যাহার অনেক সময় দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সফরে এলে তাকে বীরোচিত সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। বঙ্গবন্ধু তার বক্তৃতায় বলেন, আপনি মতিলাল নেহেরুর দৌহিত্র জওহর লাল নেহেরুর কন্যা। আপনার কাছে আমার দাবি নির্ধারিত দিবসের পূর্বেই আপনি বাংলার মাটি থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবেন। অবশ্য শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ঐ সভায় তার প্রদত্ত ভাষণে প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর দেননি। তবে পৃথিবীর ইতিহাসের বিরল দৃষ্টান্ত হিসেবে স্বল্প সময়ের মধ্যেই ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়ে যান। তার কূটনৈতিক কৌশলের আরেকটি গৌরবজনক দিক হলো মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তার বিশ্ব সফরকালীন সময়ে তিনি অঙ্গীকার করেছিলেন একটি পাকিস্তানি সৈন্যকেও যুদ্ধবন্দি করা হবে না। পূর্ব পাকিস্তানে একটি অবাঙালিকেও হত্যা করা হবে না। ছিয়ানব্বই হাজার পাকিস্তানি সৈন্যকে ভারতে নিয়ে গিয়ে সযত্নে তাদেরকে পাকিস্তানে ফিরিয়ে দিয়ে তিনি তার সেই ওয়াদাকে রক্ষা করেছিলেন। ফলে সারাবিশ্বে তার ভাবমূর্তি ভিন্নতর উচ্চতায় পৌঁছে যায়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের সকল মানুষের বিদগ্ধ চিত্তের নেত্রী হয়ে ওঠেন-ভারতেও প্রধানমন্ত্রী হতে কালজয়ী স্টেটসম্যানে পরিণত হন। তিনি যখন বাংলাদেশে আসেন তখন আমাদের চারজনের জন্য অতি সুন্দর চারটি সিগারেট কেস উপহার হিসেবে নিয়ে আসেন। যার ভেতরে একটি সুন্দর মনোরম কার্ডে ইংরেজিতে লেখা ছিল শুভেচ্ছাসহ শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। উপহারটি আনুষ্ঠানিকভাবে দেয়ার কথা ছিল। সেই আনুষ্ঠানিকতাটি হতে দেয়া হয়নি বিধায় ভারতীয় কূটনীতিকের মাধ্যমে আমাদের কাছে উপহারটি পৌঁছায়। তার মধ্যে আমার প্রাপ্য এ উপহারটি আজও অতি সযত্নে রক্ষিত আছে আমার কাছে। তাকে নিয়ে আরেকটি মজার স্মৃতি হলো বঙ্গভবনে তার সম্মানে প্রদত্ত নৈশভোজে শীর্ষ টেবিলে যেখানে তিনি এবং বঙ্গবন্ধু বসবেন তার সঙ্গে কোনাকুনি করে আমাদের টেবিলটি রাখা হয়েছিল এর মধ্যে শাজাহান সিরাজ ও আমি সস্ত্রীক ছিলাম। ছয়জনের গোলটেবিলে বসেই আমরা চারজন সিদ্ধান্ত নিলাম ছুরি-কাঁটা বর্জন করে আমরা হাত দিয়ে খাবো। কি অভূতপূর্ব অভাবনীয় ব্যাপার আমাদের হাত দিয়ে খাওয়া ত্বরিত লক্ষ্য করে তিনিও হাত দিয়ে খাওয়া শুরু করলেন। সমগ্র অতিথিবৃন্দ প্রচণ্ড হাস্যরোলে ফেটে পড়লেন। কিন্তু লক্ষ্য করে আমাদের বুঝতে কষ্ট হলো না হাত দিয়ে আহার গ্রহণ করতে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী অভ্যস্ত নন। আমরা লজ্জা পেলাম কিন্তু তখন তো আর কাঁটাচামচ, ছুরি দিয়ে পুনরায় শুরু করার সুযোগ ছিল না। এর আগে বিমানবন্দরে সারিবদ্ধ হয়ে দণ্ডায়মান অবস্থায় বঙ্গবন্ধু যখন তার সঙ্গে আমাদের চারজনের পরিচয় করিয়ে দেন তখন বিশেষ ভঙ্গিমায় স্মিথ হেসে তিনি আমাদের দিকে যেভাবে তাকান সেটাও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। আজও আমার মনে হয় ঝযব ধিং ধ ঃধরষড়ৎ সধফব ংঃধঃবংসধহ. সবকিছুই যেন নিখুঁত পরিপাটি করে সাজানো। রেসকোর্সে তার ভাষণের ভাষা ছিল হিন্দি। কিন্তু ভাষণে শব্দচয়ন এত সহজ ও সরল ছিল যে, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষেরও বুঝতে কষ্ট হয়নি। কি অদ্ভূত প্রাঞ্জল ও সুদূরপ্রসারী ছিল তার দৃষ্টিভঙ্গি। তার ভাষণের একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন অনেকদিনের শোষণ-বঞ্চনাকে ডিঙ্গিয়ে একটি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে রক্তস্নাত স্বাধীনতাকে আপনারা অর্জন করেছেন। এই অর্জনকে রক্ষা করতে হলে আপনাদেরকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। দেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার প্রচেষ্টায় সততা ও কঠিন পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। কথাটি শুধু বিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য নয় যুদ্ধে জরাজীর্ণ সকল দেশের জন্যই সর্বজনীনভাবে প্রযোজ্য। প্রাসঙ্গিকভাবে আমি এখানে উল্লেখ করতে চাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত ধ্বংসপ্রাপ্ত জার্মান ও জাপানের জনগণ পরিশ্রম, শৃঙ্খলা ও সততার মধ্য দিয়ে আজকে বিশ্বের বুকে যেরূপ গর্বিত মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে আমরা সেরূপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধকালীন চেতনা বিজয়ের পরে অনেকখানি ম্রিয়মাণ হয়ে যায়। প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার লোভ আমাদের অমলিন চিত্তকে অনেকখানি বিধ্বস্ত করে ফেলে। একদিকে স্বাধীনতা বিরোধীদের ষড়যন্ত্র অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের নিষ্কলুষ হৃদয় প্রাপ্তি-প্রত্যাশা-প্রলোভনের মেঘে আড়াল হতে থাকে। তবুও আমাদের অর্জন অনেক কিন্তু চিত্ত নির্মোহ থাকলে আমরা জার্মান ও জাপানের মতোই অর্জনে সাফল্যে গৌরবান্বিত থাকতে পারতাম।
ভারতের জন্য এটি হৃদয়বিদারক মর্মান্তিক অনভিপ্রেত যে, দেহরক্ষী কর্তৃক শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী নিহত হওয়া। বাংলাদেশের মানুষও এই মর্মান্তিক ঘটনায় দুঃসহ যন্ত্রণা অনুভব করেছে। সংবাদটি আমাকেও শোকে মুহ্যমান করে ফেলে। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়েছিল রক্তের কোনো সম্পর্ক না থাকলেও হৃদয়ের অতি নিকট মানুষটিকে আমরা হারিয়েছিলাম।