মিডিয়া কর্নার
ডীয়ার ডীয়ার এন্ড ডীয়ার
৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, শুক্রবার, ১:১৪ পূর্বাহ্ন
প্রয়াত প্রখ্যাত সাংবাদিক ফয়েজ আহমদের দেখা বহুল বঠিত গ্রন্থ ‘সত্যবাবু মারা গেছেন’। ওই বইয়ের ৭ম অধ্যায় ডীয়ার ডীয়ার এন্ড ডীয়ার:
ভারত ভ্রমণের প্রোগ্রামটা কারো কাছে অগ্রহণযোগ্য হবার কোন কারণ ছিল না। তবে আমার কথা ছিল খাজুরাহো না দেখে কি করে দেশে ফেরা যায়। কিন্তু সফরসূচীটাই এমনভাবে করা হয়েছিল যে, এবার আর খাজুরাহো পৌঁছানো যাবে না। সময় বাড়িয়ে অন্য পথে না গেলে নয়। একজন বললেন: কোনারক দিয়ে খাজুরাহো মিটিয়ে নাও।
এগার শতাব্দীর খাজুরাহোই তো তেরো শতাব্দীর কোনারকে নারীকে সুষমাম-িত করেছে বলে প-িতদের মধ্যে অনেকে মনে করেন। বুদ্ধদেব বসু বলেছেন: ‘নারীদেহে যৌনতা ও দেবতার সমন্বয় সগৌরবে ফিরে এলো কোনারকে। কোনারকে অপ্সরা যেন আলোকে আকাশে নিজকে উন্মুক্ত করে মেলে দিয়েছে, তার ঠোঁটের হাসিতে আছে ভাবোন্মাদনা আর খাজুরাহোর সুন্দরী যেন চিত্রিত হবার জন্যই দাঁড়িয়ে আছেন। মনে হয়, মুখশ্রী ও হাসি নামক আশ্চর্য বস্তু কোনারকে চরম পরিণতি লাভ করেছে।’ দেবতার এই দেশে দেবতার স্রষ্টা মানুষকে প্রধানতঃ দেখার জন্যই তো আমাদের ভ্রমণের আয়োজনÑপূরাকীর্তি দর্শনের দিকটা তো পার্শ্ব-দর্শন।
আমাদের এই সফরটা ছিল ভারতীয় সাংবাদিক সংস্থার আমন্ত্রণে। বাংলাদেশ অঞ্চলের পাঁচজন সাংবাদিককে সাতান্ন সালের শেষের দিকে ভারত সফরে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এ’দের মধ্যে প্রথম এশীয় লেখক সম্মেলনে যোগদানকারী সাহিত্যিক-সাংবাদিক সৈয়দ নুরুদ্দীন ও আমি দিল্লীতেই ছিলাম। অপর তিনজন আমন্ত্রিত সাংবাদিক মর্নিং নিউজের এ. এল খাতিব, ইউপিপির আবদুল মতিন ও এপিপির মাহবুবুল আলম ইতিমধ্যেই দিল্লীতে এসে পৌঁছেছেন। এশীয় সম্মেলন শেষ হবার পরই সেই সফর শুরু হবার কথা। আগ্রা হয়ে আরম্ভ হবে আমাদের যাত্রা ভারতীয় সাংবাদিক ঈশ্বরচন্দ্রের তত্ত্বাবধানে।
ঢাকা, কলম্বো, করাচী, বোম্বে ও দিল্লীতে সুপরিচিত বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক এ. এল খাতিব পুনার অধিবাসী। পঞ্চাশের যুগের ঢাকায় বিশিষ্ট সাংবাদিক আবদুল মতিনকে বর্তমানে এদেশে অনেকেই চেনেন না। দীর্ঘদিন সাংবাদিকতার পর তিনি ইউরোপ হয়ে লন্ডনে চলে যান এবং সেখানে চাকুরিরত অবস্থায় ব্যক্তিগতভাবে একটি ইংরেজী সাময়িকী প্রকাশ করছেন। সেদিনকার তরুন সাংবাদিক মাহবুবুল আলম বর্তমানে একজন রাষ্ট্রদূত। আমাদের পাঁচজনকে নিয়ে যে যাত্রা শুরু হল তার যে প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল প্রাচীন ও মধ্যযুগের ভারত আবিষ্কার। প্রধানতঃ স্থাপত্যশিল্পের নির্দশন দেখেই দিল্লী, আগ্রা, ফতেপুরসিক্রি আর জয়পুর অতিক্রম করলাম। প্রত্যেক স্থানেই ট্রেনিংপ্রাপ্ত গাইডগণ বিশ্বাসযোগ্য বা অবিশ্বাস্য কিংবদন্তী শুনিয়ে যেতে লাগলেন। এই সব কিংবদন্তীর অধিকাংশই ইতিহাসভুক্ত নয়। লাল পাহাড়ের রাজধানী ফতেপুরসিক্রিতে যে গাইড যুবক আমাদের আকবরের আমলের প্রাসাদ ও অন্যান্য শিল্পকর্ম ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন, তার বাচনভঙ্গি ও রসজ্ঞান অপূর্ব।
তিনি আমাদের সম্রাট আকবরের নবরতœ সভার পশ্চাৎবর্তী উন্মুক্ত চত্বরে নিয়ে বললেন: দেখুন, এই ক্ষুদ্র স্থানটি সম্পর্কে যে মিষ্টি কিংবদন্তী রয়েছে, তা’ ইতিহাসের সত্য।
‘আমরা এসেছি সত্যের সন্ধানে। সুতরাং ইতিহাসের কিংবদন্তী শুনব।’
:যুবরাজ সেলিম এখানে দাঁড়িয়ে কবুতর নিয়ে খেলতেন। তাঁর সঙ্গে থাকতেন প্রিয় বান্ধবীদের দল। পুষ্পকোরক পরিবেষ্টিত যুবরাজ। ওই যে নবরতœ সভা, সেখান থেকে হুকুম আসত যুবরাজকে নিয়ে যেতে। ভারত সম্রাট রাজকার্য শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে কোন কোন সময় নবরতœ সবায় যুবরাজ সেলিমকে (পরবর্তী কালে সম্রাট জাহাঙ্গীর) ডেকে পাঠাতেন এবং প্রয়োজনে তার সম্মুখেই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতেন।
: এখনো তো কিংবদন্তী পাচ্ছি না। এতো ইতিহাস।
: এই কিংবদন্তী ইতিহাস থেকেই উৎসারিত কিনা, সেজন্যে কথাগুলো যুবরাজকে এক্ষুণি যেতে হবে। কিন্তু সে সময় হাতে তার আকাশে ‘পলট’ খায় এমন দুটো দামী পায়রা। তড়িৎ গতিতে হাতের কাছে উপস্থিত এক সুন্দরী বান্ধবীকে পায়রা দুটো দিয়ে চলে গেলেন সম্রাটের ডাকে। ফিরে এসে দেখলেন সবাই চলে গেছে, কেবলমাত্র সেই বান্ধবী বাঁ হাতে একটি পায়রা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। যুবরাজ ক্ষুব্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আর একটি কোথায়?’ বান্ধবী বললেন, ‘উড়ে গেছে। উত্তপ্ত যুবরাজ গর্জন করে উঠলেন, ‘কি ভাবে?’ বাঁ হাতের মুঠো থেকে দ্বিতীয় পায়রাটি আকাশে উড়িয়ে দিয়ে সেই সুন্দরী বান্ধবী বললেন, ‘এই ভাবে।’
: সাহস বলতে হবে। গর্দান যাবার কথা।
: না, তিনি সাম্রাজ্য পেয়েছিলেন। যুবরাজ সেলিম বান্ধবীর দুঃসাহস দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। কিন্তু পরক্ষণেই সেই বান্ধবীকে বাহু বন্ধ করে বললেন, ‘চলো, তোমার মতো সাহসিনীই কেবল আমার সম্রাজ্ঞী হতে পারে।’ আপনারা জানেন এই সেই সম্রাজ্ঞী নূর জাহান।
হাজারো পর্যটককে হয়তো এই যুবক গাইড এই মধুময় কিংবদন্তীট বলেছেন এবং তারা আমাদের মতোই মুগ্ধ হয়ে শুনেছেন। বললাম: ইতিহাসের সত্য হলে আপনার কাছ থেকে এমন অপূর্ব করে কিংবদন্তীটি উপভোগ করতে পারতাম না।
: সেজন্যেই আমরা রয়েছি। পরিপূরক।
আবার আমাদের যাত্রা শুরু হলো: সাঁচী, এলিফ্যান্টা, ঔরঙ্গাবাদ, ইলোরা, অজন্তার পথে।
মহাবালিপুরম ও মহীশুর থেকে টিপু সুলতানের রাজধানী শ্রীরঙ্গপত্তাম উপস্থিত হলাম। এই সুরক্ষিত প্রাচীন শহরটির নগর-প্রাচীর এখনো অতীতের সাক্ষ্য বহন করে চলছে। হায়দারাবাদের নিজামের সৈন্যবাহিনীর সহযোগিতার ইংরেজ গভর্নর জেনারেল কর্ণওয়ালিশ ১৭৯৯ সালের ফেব্রুয়ারি এই রাজধানী আক্রমণ করেন মহীশুর দখল করার জন্যে। ইংরেজ ও তার মিত্রদের প্রচ- আক্রমণে বহির্দুগের পতন ঘটে এবং এরপরই নগর প্রাচীরের এক অংশ ধ্বংসের পর শত্রু সৈন্য রাজধানীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। টিপু সুলতান সে সময় স্বয়ং যুদ্ধ পরিচালনা করছিলেন ও যুদ্ধরত ছিলেন। ইতিহাসের এই অংশটুকু বলার পর আমাদের স্থানীয় গাইড বললেন: ‘ও্ সামনে চলুন। একটু এগিয়েই সম্মুখে একটি প্রস্তর ফলক দেখলাম। লেখা রয়েছে-‘এই স্থানে টিপু সুলতানের দেহ পাওয়া গেছে।’ এখানেই বীর সুলতানকে স্বাধীনতা রক্ষা করতে গিয়ে এদেশের অপর নৃপতির বিশ্বাসঘাতকায় প্রাণ দিতে হয়েছে।
গাইড আমাদের একটু এগিয়ে দেয়ালের পাশে নিয়ে গিয়ে একটি ভূগর্ভস্থ কক্ষ দেখিয়ে বললেন: ইংরেজরা পৌনে দু’শ বছর শাসনকালে অপপ্রচার করেছে যে, ‘এই ডানজেন’ বা অন্ধকূপটিতে টিপু সুলতান বন্দী ইংরেজ সৈন্যদের আবদ্ধ রেখে হত্যা করেছে। কিন্তু ইতিহাসে এই প্রচার সত্য বলে প্রমাণিত হয়নি। এই ভূগর্ভস্থ কক্ষটি হয়তো যুদ্ধকালে আত্মরক্ষার স্থান হিসেবে দুর্গের একপ্রান্তে নির্মাণ করা হয়েছিল।
আমরা প্রস্তর ফলকটির স্মৃতি বহন করে বাঙালোরের দিকে পথ ধরলাম। পরে আমরা পুরী, কোনারক, ভূবনেশ্বর হয়ে কলকাতার দিকে যাত্রা করেছিলাম। বাঙালোরে আমরা মুগ্ধ হয়েছি ভাস্কর্য, স্থাপত্য শিল্প বা ঐতিহাসিক নির্দশন দেখে নয়Ñএকজন অসাধারণ প্রতিভাধর আধুনিক মানুষের ঔজ্জ্বল্য দর্শনে।
বাঙালোরের বহুবিধ আকর্ষণের মধ্যে আমরা যার প্রতি সর্বাধিক আকৃষ্ট ছিলাম, তিনি হচ্ছেন স্যার চন্দ্রশেখর ভেঙকট রমনÑসি, ভি রমন। ত্রিশ সালে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত এই বিশ্ববিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানীর সাক্ষাৎ পাওয়া যাবে কিনা, সে সম্পর্কে আমাদের সাথে সফররত ভারতীয় সাংবাদিক বন্ধু নিশ্চয়তাদান করতে পারলেন না। ভারত সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত রমন গবেষণা ইন্সটিটিউটের তিনি প্রধান পরিচালক। তাঁর ইচ্ছা ও বাছাই-এর বাইরে কোন বিজ্ঞানী বা ছাত্রকে এই প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করা হতো না। এই চঞ্চল ও একটু খেয়ালী বিজ্ঞানীর মেজাজ সম্পর্কে পূর্বাভাস কিছুই করা যেতো না বলে আমাদের সাক্ষাৎ অনিশ্চিত ছিল।
কিন্তু পরের দিন সকালে তাঁর গবেষণাগার ইন্সটিটিউট পরিবদর্শনের নিমন্ত্রণ আসল আকস্মিকভাবে। তিনি আমাদের সাথে কথা বলবেন বলেও আমাদের জানানো হলো। দক্ষিণ ভারতীয় পোশাকে সজ্জিত বৈজ্ঞানিক রমন আমাদের নিচে এসে অভ্যর্থনা জানিয়ে না। এই চঞ্চল ও একটু খেয়ালী বিজ্ঞানীর মেজাজ সম্পর্কে পূর্বাভাস কিছুই করা যেতো না বলে আমাদের সাক্ষাৎ অনিশ্চিত ছিল।
কিন্তু পরের দিন সকালে তাঁর গবেষণাগার ইন্সটিটিউট পরিদর্শনের নিমন্ত্রণ আসল আকস্মিকভাবে। তিনি আমাদের সাথে কথা বলবেন বলেও আমাদের জানানো হলো। দক্ষিণ ভারতীয় পোশাকে সজ্জিত বৈজ্ঞানিক রমন আমাদের নিচে এসে অভ্যর্থনা জানিয়ে অনর্গল কথা বলে চললেন। এমন একজন অসাধারণ ব্যক্তির কথা শোনাটা আমরা স্থির করলাম, নিজেদের বক্তব্য সংযত করে।
প্রথমেই তিনি বাঙালীদের সাথে সম্পর্কের কথা উঠিয়ে বললেন: আপনাদের সাথে আমার সম্পর্ক সারা জীবনের। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েই কাটিয়েছি ঘোষ বছরের মতো, ঢাকায় গিয়েছি। তাই ভাবলাম আপনাদের সাথে দেখা হরে ভালোই হয়, কিছুক্ষণ কথা বলা যাবে।’
একটু থেমে বললেন: তবে সাংবাদিকদের সম্পর্কে আমার মতামত মধুর নয়, কারণ অভিজ্ঞতা তিক্ত।
তিনি অনর্গল কথা বলতে পারেন। বলে চললেন: কি সর্বনেশে কথা। ছেলেটা লিখে দিল আমি স্বর্ণ তৈরী করতে পারি। ব্যস, আর যাই কোথায়! হাজার হাজার চিঠি আর টেলিগ্রাম এলো অভিনন্দন জানিয়ে। অনেকে তো আমার বাড়িতে এসে উপস্থিত লক্ষ লক্ষ ডলার নিয়ে।’
তিনি হো হো করে হেসে বললেন: আমাকে ওরা সোনা বানিয়ে দিতে বলল। আসলে কি জানেন, ওই যে সাংবাদিক, যাকে একদিন আমার লেকচার থিয়েটারে বসতে দিয়েছিলাম, সে-ই সব সর্বনাশের মূলে। বিজ্ঞানের সেই বক্তৃতা সে মাথামু-ু কিছুই বুঝতে পারেনি। কিন্তু লিখে দিয়েছিল আমি সোনা বানাতে পারি! ডাহা মিথ্যা। মিথ্যা’ (অ্যারেন্ট লাই)।
বৃদ্ধ বিজ্ঞানী রাগ থামিয়ে বললে: আমার সেই বক্তৃতাটা ছিল, সোনা কি করে তৈরি হতে পারে তার ওপরÑ গবেষণালবদ্ধ থিওরী মাত্র। সোনা বানানোর সূত্র আর সোনা বানানোর ক্ষমতা দু’টো যে আকাশ পাতাল ফারাগ।’
হেসে বলে চললেন: থিওরী বানানো যায়, সোনা তৈরী করা তো যায় না। সেই থেকে সাংবাদিকদের সাথে বা তাদের সম্মুখে কোন কথা বলি না। কি যে কা- করে বসে।’
‘চলুন, আপনাদের কক্ষগুলো দেখাই।’ এই বলে তিনি ওপরে প্রথমে যে সেলুনে নিয়ে গেলেন, সেটা ছিল বিশ্বের বিরল পাখির যেন মিউজিয়ামÑ সর্বত্র বসিয়ে বা ঝুলিয়ে রাখা স্টাফ করা পাখি। এ তাঁর সখ।
তারপর আমরা তাঁর প্রধান গবেষণা যাদুঘরে প্রবেশ করলাম। ‘রমন এফেক্ট’-এর আবিষ্কারক সি, ভি রমন বহুসংখ্যক নানা রঙের প্রস্তর খ- দেখিয়ে বললেন: বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কোটিপতি ধনী ব্যক্তিরা গভেষণা করার জন্যে এই সমস্ত হীরক খ-, অমূল্য প্রস্তর আমাকে পাঠিয়েছেন। এদের অনেকগুলো সর্বদাই তরঙ্গাকার রশ্মি বিক্ষিপ্তভাবে বিচ্ছুরিত করছে। আপনারা সাদা চোখে কিছুই দেখছেন না, দেখছেন প্রস্তরের আলোকিত বিন্দুগুলো।
এই কথা বলার পর তিনি দু’জন দু’জন করে আমাদের একটি পার্শ্ববর্তী ক্ষুদ্র কক্ষে নিয়ে গেলেন। অন্ধকার কক্ষটির এক পাশে কয়েকটি হীরক জাতীয় বৃহৎ খ- সজ্জিত ছিল। বিশেষ ব্যবস্থাধীনে প্রস্তর খ-গুলোতে বৈদ্যুতিক আলো ফেলার পর নানা রঙের আলো বিচ্ছুরিত হতে লাগল। আলোর রঙের ওপর নির্ভর করে প্রস্তরের রঙ পরবর্তিত হচ্ছিল। এই ঐন্দ্রজালিক পরিবেশে কেউ কোন কথা বলতে পারিনি।
কক্ষের বাইরে এসে বিজ্ঞানী রমন হেসে বললেন: আপনারা অবাকই শুধু হরেন। জানেন, বিজ্ঞানের এই রহস্য মানব কল্যাণে প্রয়োগের প্রচেষ্টা এখনো পূর্ণভাবে সাফল্য লাভ করেনি। কেবলমাত্র গবেষণাই মানুষকে বাঁচাতে পারে। তাই এই অব্যাহত গবেষণা।
দাঁড়িয়ে কথা বলার সময় হাতের কাছে একটি তাকের ওপর রক্ষিত অন্যান্য দ্রব্যের মধ্য থেকে একটি মূল্যবান প্রস্তরের হরিণ উঠিয়ে আবার হাসতে হাসতে তিনি বললেন: এটা আমার হরিণ।
ছ’ইঞ্চি লম্বা এই হীরক সদৃশ্য প্রস্তর খ-টি দক্ষিণ আফ্রিকার এক ধনী ব্যক্তি খনি থেকে উদ্ধার করে বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিদ রবার্ট আপেনহেমারের মাধ্যমে বিজ্ঞানী রমনকে গবেষণার জন্যে পাঠিয়েছিলেন। তিনি সেটাকে হরিণের আকৃতি দিয়ে গবেষণাগার সাজিয়েছেন।
সযতেœ হরিণটি তাকের ওপর রাখার সময় তিনি আবার বললেন: দিস্ ইজ মাই ডীয়ার এন্ড ডীয়ার। (আমার হরিণ, আমার প্রিয় হরিণ এবং মহামূল্যবান সে)। সেলিম-প্রেমিক-কপোত কাহিনী, কাঁচীর স্তূপ, এলিফ্যান্টার প্রস্তুতর মূর্তি অজন্তার মার কন্যা, মহাবালিপুরমের মনোলিথিক হস্তী, খাজুরাহো ও কোনারকের রমণী আর বাঙালোরের বৃন্দাবন হ্রদের স্বগীয় পরিবেশকে ছাপিয়ে উজ্জ্বল আলোর বিশ্লেষক রক্ত-মাংসের মানুষটি আমাদের অভিভূত করে রাখলেন।
সমগ্র অতীত ও বর্তমানের সমন্বিত প্রতীকের বিচ্ছুরিত আলোর সম্মুখে আমরা। আমরা যেন সবাই বলে উঠলামÑ ডীয়ার, ডীয়ার এন্ড ডীয়ার।
[আগামীকাল পড়ুন বইটির ৮ম অধ্যায়: থ্যাংক ইউ মিঃ মিটার]
ভারত ভ্রমণের প্রোগ্রামটা কারো কাছে অগ্রহণযোগ্য হবার কোন কারণ ছিল না। তবে আমার কথা ছিল খাজুরাহো না দেখে কি করে দেশে ফেরা যায়। কিন্তু সফরসূচীটাই এমনভাবে করা হয়েছিল যে, এবার আর খাজুরাহো পৌঁছানো যাবে না। সময় বাড়িয়ে অন্য পথে না গেলে নয়। একজন বললেন: কোনারক দিয়ে খাজুরাহো মিটিয়ে নাও।
এগার শতাব্দীর খাজুরাহোই তো তেরো শতাব্দীর কোনারকে নারীকে সুষমাম-িত করেছে বলে প-িতদের মধ্যে অনেকে মনে করেন। বুদ্ধদেব বসু বলেছেন: ‘নারীদেহে যৌনতা ও দেবতার সমন্বয় সগৌরবে ফিরে এলো কোনারকে। কোনারকে অপ্সরা যেন আলোকে আকাশে নিজকে উন্মুক্ত করে মেলে দিয়েছে, তার ঠোঁটের হাসিতে আছে ভাবোন্মাদনা আর খাজুরাহোর সুন্দরী যেন চিত্রিত হবার জন্যই দাঁড়িয়ে আছেন। মনে হয়, মুখশ্রী ও হাসি নামক আশ্চর্য বস্তু কোনারকে চরম পরিণতি লাভ করেছে।’ দেবতার এই দেশে দেবতার স্রষ্টা মানুষকে প্রধানতঃ দেখার জন্যই তো আমাদের ভ্রমণের আয়োজনÑপূরাকীর্তি দর্শনের দিকটা তো পার্শ্ব-দর্শন।
আমাদের এই সফরটা ছিল ভারতীয় সাংবাদিক সংস্থার আমন্ত্রণে। বাংলাদেশ অঞ্চলের পাঁচজন সাংবাদিককে সাতান্ন সালের শেষের দিকে ভারত সফরে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এ’দের মধ্যে প্রথম এশীয় লেখক সম্মেলনে যোগদানকারী সাহিত্যিক-সাংবাদিক সৈয়দ নুরুদ্দীন ও আমি দিল্লীতেই ছিলাম। অপর তিনজন আমন্ত্রিত সাংবাদিক মর্নিং নিউজের এ. এল খাতিব, ইউপিপির আবদুল মতিন ও এপিপির মাহবুবুল আলম ইতিমধ্যেই দিল্লীতে এসে পৌঁছেছেন। এশীয় সম্মেলন শেষ হবার পরই সেই সফর শুরু হবার কথা। আগ্রা হয়ে আরম্ভ হবে আমাদের যাত্রা ভারতীয় সাংবাদিক ঈশ্বরচন্দ্রের তত্ত্বাবধানে।
ঢাকা, কলম্বো, করাচী, বোম্বে ও দিল্লীতে সুপরিচিত বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক এ. এল খাতিব পুনার অধিবাসী। পঞ্চাশের যুগের ঢাকায় বিশিষ্ট সাংবাদিক আবদুল মতিনকে বর্তমানে এদেশে অনেকেই চেনেন না। দীর্ঘদিন সাংবাদিকতার পর তিনি ইউরোপ হয়ে লন্ডনে চলে যান এবং সেখানে চাকুরিরত অবস্থায় ব্যক্তিগতভাবে একটি ইংরেজী সাময়িকী প্রকাশ করছেন। সেদিনকার তরুন সাংবাদিক মাহবুবুল আলম বর্তমানে একজন রাষ্ট্রদূত। আমাদের পাঁচজনকে নিয়ে যে যাত্রা শুরু হল তার যে প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল প্রাচীন ও মধ্যযুগের ভারত আবিষ্কার। প্রধানতঃ স্থাপত্যশিল্পের নির্দশন দেখেই দিল্লী, আগ্রা, ফতেপুরসিক্রি আর জয়পুর অতিক্রম করলাম। প্রত্যেক স্থানেই ট্রেনিংপ্রাপ্ত গাইডগণ বিশ্বাসযোগ্য বা অবিশ্বাস্য কিংবদন্তী শুনিয়ে যেতে লাগলেন। এই সব কিংবদন্তীর অধিকাংশই ইতিহাসভুক্ত নয়। লাল পাহাড়ের রাজধানী ফতেপুরসিক্রিতে যে গাইড যুবক আমাদের আকবরের আমলের প্রাসাদ ও অন্যান্য শিল্পকর্ম ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন, তার বাচনভঙ্গি ও রসজ্ঞান অপূর্ব।
তিনি আমাদের সম্রাট আকবরের নবরতœ সভার পশ্চাৎবর্তী উন্মুক্ত চত্বরে নিয়ে বললেন: দেখুন, এই ক্ষুদ্র স্থানটি সম্পর্কে যে মিষ্টি কিংবদন্তী রয়েছে, তা’ ইতিহাসের সত্য।
‘আমরা এসেছি সত্যের সন্ধানে। সুতরাং ইতিহাসের কিংবদন্তী শুনব।’
:যুবরাজ সেলিম এখানে দাঁড়িয়ে কবুতর নিয়ে খেলতেন। তাঁর সঙ্গে থাকতেন প্রিয় বান্ধবীদের দল। পুষ্পকোরক পরিবেষ্টিত যুবরাজ। ওই যে নবরতœ সভা, সেখান থেকে হুকুম আসত যুবরাজকে নিয়ে যেতে। ভারত সম্রাট রাজকার্য শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে কোন কোন সময় নবরতœ সবায় যুবরাজ সেলিমকে (পরবর্তী কালে সম্রাট জাহাঙ্গীর) ডেকে পাঠাতেন এবং প্রয়োজনে তার সম্মুখেই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতেন।
: এখনো তো কিংবদন্তী পাচ্ছি না। এতো ইতিহাস।
: এই কিংবদন্তী ইতিহাস থেকেই উৎসারিত কিনা, সেজন্যে কথাগুলো যুবরাজকে এক্ষুণি যেতে হবে। কিন্তু সে সময় হাতে তার আকাশে ‘পলট’ খায় এমন দুটো দামী পায়রা। তড়িৎ গতিতে হাতের কাছে উপস্থিত এক সুন্দরী বান্ধবীকে পায়রা দুটো দিয়ে চলে গেলেন সম্রাটের ডাকে। ফিরে এসে দেখলেন সবাই চলে গেছে, কেবলমাত্র সেই বান্ধবী বাঁ হাতে একটি পায়রা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। যুবরাজ ক্ষুব্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আর একটি কোথায়?’ বান্ধবী বললেন, ‘উড়ে গেছে। উত্তপ্ত যুবরাজ গর্জন করে উঠলেন, ‘কি ভাবে?’ বাঁ হাতের মুঠো থেকে দ্বিতীয় পায়রাটি আকাশে উড়িয়ে দিয়ে সেই সুন্দরী বান্ধবী বললেন, ‘এই ভাবে।’
: সাহস বলতে হবে। গর্দান যাবার কথা।
: না, তিনি সাম্রাজ্য পেয়েছিলেন। যুবরাজ সেলিম বান্ধবীর দুঃসাহস দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। কিন্তু পরক্ষণেই সেই বান্ধবীকে বাহু বন্ধ করে বললেন, ‘চলো, তোমার মতো সাহসিনীই কেবল আমার সম্রাজ্ঞী হতে পারে।’ আপনারা জানেন এই সেই সম্রাজ্ঞী নূর জাহান।
হাজারো পর্যটককে হয়তো এই যুবক গাইড এই মধুময় কিংবদন্তীট বলেছেন এবং তারা আমাদের মতোই মুগ্ধ হয়ে শুনেছেন। বললাম: ইতিহাসের সত্য হলে আপনার কাছ থেকে এমন অপূর্ব করে কিংবদন্তীটি উপভোগ করতে পারতাম না।
: সেজন্যেই আমরা রয়েছি। পরিপূরক।
আবার আমাদের যাত্রা শুরু হলো: সাঁচী, এলিফ্যান্টা, ঔরঙ্গাবাদ, ইলোরা, অজন্তার পথে।
মহাবালিপুরম ও মহীশুর থেকে টিপু সুলতানের রাজধানী শ্রীরঙ্গপত্তাম উপস্থিত হলাম। এই সুরক্ষিত প্রাচীন শহরটির নগর-প্রাচীর এখনো অতীতের সাক্ষ্য বহন করে চলছে। হায়দারাবাদের নিজামের সৈন্যবাহিনীর সহযোগিতার ইংরেজ গভর্নর জেনারেল কর্ণওয়ালিশ ১৭৯৯ সালের ফেব্রুয়ারি এই রাজধানী আক্রমণ করেন মহীশুর দখল করার জন্যে। ইংরেজ ও তার মিত্রদের প্রচ- আক্রমণে বহির্দুগের পতন ঘটে এবং এরপরই নগর প্রাচীরের এক অংশ ধ্বংসের পর শত্রু সৈন্য রাজধানীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। টিপু সুলতান সে সময় স্বয়ং যুদ্ধ পরিচালনা করছিলেন ও যুদ্ধরত ছিলেন। ইতিহাসের এই অংশটুকু বলার পর আমাদের স্থানীয় গাইড বললেন: ‘ও্ সামনে চলুন। একটু এগিয়েই সম্মুখে একটি প্রস্তর ফলক দেখলাম। লেখা রয়েছে-‘এই স্থানে টিপু সুলতানের দেহ পাওয়া গেছে।’ এখানেই বীর সুলতানকে স্বাধীনতা রক্ষা করতে গিয়ে এদেশের অপর নৃপতির বিশ্বাসঘাতকায় প্রাণ দিতে হয়েছে।
গাইড আমাদের একটু এগিয়ে দেয়ালের পাশে নিয়ে গিয়ে একটি ভূগর্ভস্থ কক্ষ দেখিয়ে বললেন: ইংরেজরা পৌনে দু’শ বছর শাসনকালে অপপ্রচার করেছে যে, ‘এই ডানজেন’ বা অন্ধকূপটিতে টিপু সুলতান বন্দী ইংরেজ সৈন্যদের আবদ্ধ রেখে হত্যা করেছে। কিন্তু ইতিহাসে এই প্রচার সত্য বলে প্রমাণিত হয়নি। এই ভূগর্ভস্থ কক্ষটি হয়তো যুদ্ধকালে আত্মরক্ষার স্থান হিসেবে দুর্গের একপ্রান্তে নির্মাণ করা হয়েছিল।
আমরা প্রস্তর ফলকটির স্মৃতি বহন করে বাঙালোরের দিকে পথ ধরলাম। পরে আমরা পুরী, কোনারক, ভূবনেশ্বর হয়ে কলকাতার দিকে যাত্রা করেছিলাম। বাঙালোরে আমরা মুগ্ধ হয়েছি ভাস্কর্য, স্থাপত্য শিল্প বা ঐতিহাসিক নির্দশন দেখে নয়Ñএকজন অসাধারণ প্রতিভাধর আধুনিক মানুষের ঔজ্জ্বল্য দর্শনে।
বাঙালোরের বহুবিধ আকর্ষণের মধ্যে আমরা যার প্রতি সর্বাধিক আকৃষ্ট ছিলাম, তিনি হচ্ছেন স্যার চন্দ্রশেখর ভেঙকট রমনÑসি, ভি রমন। ত্রিশ সালে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত এই বিশ্ববিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানীর সাক্ষাৎ পাওয়া যাবে কিনা, সে সম্পর্কে আমাদের সাথে সফররত ভারতীয় সাংবাদিক বন্ধু নিশ্চয়তাদান করতে পারলেন না। ভারত সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত রমন গবেষণা ইন্সটিটিউটের তিনি প্রধান পরিচালক। তাঁর ইচ্ছা ও বাছাই-এর বাইরে কোন বিজ্ঞানী বা ছাত্রকে এই প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করা হতো না। এই চঞ্চল ও একটু খেয়ালী বিজ্ঞানীর মেজাজ সম্পর্কে পূর্বাভাস কিছুই করা যেতো না বলে আমাদের সাক্ষাৎ অনিশ্চিত ছিল।
কিন্তু পরের দিন সকালে তাঁর গবেষণাগার ইন্সটিটিউট পরিবদর্শনের নিমন্ত্রণ আসল আকস্মিকভাবে। তিনি আমাদের সাথে কথা বলবেন বলেও আমাদের জানানো হলো। দক্ষিণ ভারতীয় পোশাকে সজ্জিত বৈজ্ঞানিক রমন আমাদের নিচে এসে অভ্যর্থনা জানিয়ে না। এই চঞ্চল ও একটু খেয়ালী বিজ্ঞানীর মেজাজ সম্পর্কে পূর্বাভাস কিছুই করা যেতো না বলে আমাদের সাক্ষাৎ অনিশ্চিত ছিল।
কিন্তু পরের দিন সকালে তাঁর গবেষণাগার ইন্সটিটিউট পরিদর্শনের নিমন্ত্রণ আসল আকস্মিকভাবে। তিনি আমাদের সাথে কথা বলবেন বলেও আমাদের জানানো হলো। দক্ষিণ ভারতীয় পোশাকে সজ্জিত বৈজ্ঞানিক রমন আমাদের নিচে এসে অভ্যর্থনা জানিয়ে অনর্গল কথা বলে চললেন। এমন একজন অসাধারণ ব্যক্তির কথা শোনাটা আমরা স্থির করলাম, নিজেদের বক্তব্য সংযত করে।
প্রথমেই তিনি বাঙালীদের সাথে সম্পর্কের কথা উঠিয়ে বললেন: আপনাদের সাথে আমার সম্পর্ক সারা জীবনের। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েই কাটিয়েছি ঘোষ বছরের মতো, ঢাকায় গিয়েছি। তাই ভাবলাম আপনাদের সাথে দেখা হরে ভালোই হয়, কিছুক্ষণ কথা বলা যাবে।’
একটু থেমে বললেন: তবে সাংবাদিকদের সম্পর্কে আমার মতামত মধুর নয়, কারণ অভিজ্ঞতা তিক্ত।
তিনি অনর্গল কথা বলতে পারেন। বলে চললেন: কি সর্বনেশে কথা। ছেলেটা লিখে দিল আমি স্বর্ণ তৈরী করতে পারি। ব্যস, আর যাই কোথায়! হাজার হাজার চিঠি আর টেলিগ্রাম এলো অভিনন্দন জানিয়ে। অনেকে তো আমার বাড়িতে এসে উপস্থিত লক্ষ লক্ষ ডলার নিয়ে।’
তিনি হো হো করে হেসে বললেন: আমাকে ওরা সোনা বানিয়ে দিতে বলল। আসলে কি জানেন, ওই যে সাংবাদিক, যাকে একদিন আমার লেকচার থিয়েটারে বসতে দিয়েছিলাম, সে-ই সব সর্বনাশের মূলে। বিজ্ঞানের সেই বক্তৃতা সে মাথামু-ু কিছুই বুঝতে পারেনি। কিন্তু লিখে দিয়েছিল আমি সোনা বানাতে পারি! ডাহা মিথ্যা। মিথ্যা’ (অ্যারেন্ট লাই)।
বৃদ্ধ বিজ্ঞানী রাগ থামিয়ে বললে: আমার সেই বক্তৃতাটা ছিল, সোনা কি করে তৈরি হতে পারে তার ওপরÑ গবেষণালবদ্ধ থিওরী মাত্র। সোনা বানানোর সূত্র আর সোনা বানানোর ক্ষমতা দু’টো যে আকাশ পাতাল ফারাগ।’
হেসে বলে চললেন: থিওরী বানানো যায়, সোনা তৈরী করা তো যায় না। সেই থেকে সাংবাদিকদের সাথে বা তাদের সম্মুখে কোন কথা বলি না। কি যে কা- করে বসে।’
‘চলুন, আপনাদের কক্ষগুলো দেখাই।’ এই বলে তিনি ওপরে প্রথমে যে সেলুনে নিয়ে গেলেন, সেটা ছিল বিশ্বের বিরল পাখির যেন মিউজিয়ামÑ সর্বত্র বসিয়ে বা ঝুলিয়ে রাখা স্টাফ করা পাখি। এ তাঁর সখ।
তারপর আমরা তাঁর প্রধান গবেষণা যাদুঘরে প্রবেশ করলাম। ‘রমন এফেক্ট’-এর আবিষ্কারক সি, ভি রমন বহুসংখ্যক নানা রঙের প্রস্তর খ- দেখিয়ে বললেন: বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কোটিপতি ধনী ব্যক্তিরা গভেষণা করার জন্যে এই সমস্ত হীরক খ-, অমূল্য প্রস্তর আমাকে পাঠিয়েছেন। এদের অনেকগুলো সর্বদাই তরঙ্গাকার রশ্মি বিক্ষিপ্তভাবে বিচ্ছুরিত করছে। আপনারা সাদা চোখে কিছুই দেখছেন না, দেখছেন প্রস্তরের আলোকিত বিন্দুগুলো।
এই কথা বলার পর তিনি দু’জন দু’জন করে আমাদের একটি পার্শ্ববর্তী ক্ষুদ্র কক্ষে নিয়ে গেলেন। অন্ধকার কক্ষটির এক পাশে কয়েকটি হীরক জাতীয় বৃহৎ খ- সজ্জিত ছিল। বিশেষ ব্যবস্থাধীনে প্রস্তর খ-গুলোতে বৈদ্যুতিক আলো ফেলার পর নানা রঙের আলো বিচ্ছুরিত হতে লাগল। আলোর রঙের ওপর নির্ভর করে প্রস্তরের রঙ পরবর্তিত হচ্ছিল। এই ঐন্দ্রজালিক পরিবেশে কেউ কোন কথা বলতে পারিনি।
কক্ষের বাইরে এসে বিজ্ঞানী রমন হেসে বললেন: আপনারা অবাকই শুধু হরেন। জানেন, বিজ্ঞানের এই রহস্য মানব কল্যাণে প্রয়োগের প্রচেষ্টা এখনো পূর্ণভাবে সাফল্য লাভ করেনি। কেবলমাত্র গবেষণাই মানুষকে বাঁচাতে পারে। তাই এই অব্যাহত গবেষণা।
দাঁড়িয়ে কথা বলার সময় হাতের কাছে একটি তাকের ওপর রক্ষিত অন্যান্য দ্রব্যের মধ্য থেকে একটি মূল্যবান প্রস্তরের হরিণ উঠিয়ে আবার হাসতে হাসতে তিনি বললেন: এটা আমার হরিণ।
ছ’ইঞ্চি লম্বা এই হীরক সদৃশ্য প্রস্তর খ-টি দক্ষিণ আফ্রিকার এক ধনী ব্যক্তি খনি থেকে উদ্ধার করে বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিদ রবার্ট আপেনহেমারের মাধ্যমে বিজ্ঞানী রমনকে গবেষণার জন্যে পাঠিয়েছিলেন। তিনি সেটাকে হরিণের আকৃতি দিয়ে গবেষণাগার সাজিয়েছেন।
সযতেœ হরিণটি তাকের ওপর রাখার সময় তিনি আবার বললেন: দিস্ ইজ মাই ডীয়ার এন্ড ডীয়ার। (আমার হরিণ, আমার প্রিয় হরিণ এবং মহামূল্যবান সে)। সেলিম-প্রেমিক-কপোত কাহিনী, কাঁচীর স্তূপ, এলিফ্যান্টার প্রস্তুতর মূর্তি অজন্তার মার কন্যা, মহাবালিপুরমের মনোলিথিক হস্তী, খাজুরাহো ও কোনারকের রমণী আর বাঙালোরের বৃন্দাবন হ্রদের স্বগীয় পরিবেশকে ছাপিয়ে উজ্জ্বল আলোর বিশ্লেষক রক্ত-মাংসের মানুষটি আমাদের অভিভূত করে রাখলেন।
সমগ্র অতীত ও বর্তমানের সমন্বিত প্রতীকের বিচ্ছুরিত আলোর সম্মুখে আমরা। আমরা যেন সবাই বলে উঠলামÑ ডীয়ার, ডীয়ার এন্ড ডীয়ার।
[আগামীকাল পড়ুন বইটির ৮ম অধ্যায়: থ্যাংক ইউ মিঃ মিটার]