বই থেকে নেয়া

উত্তম কুমারের অজানা কথা (১৯)

‘বুঝলাম আমাকে মেরে ভাগিয়ে দেওয়া হবে’

৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, শুক্রবার, ১২:৪৬ অপরাহ্ন

বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি মহানায়ক উত্তম কুমার অনন্য অভিনয় জাদুতে মুগ্ধতা বিলিয়েছেন দুর্নিবার। তার অভিনীত ছবি মানেই ভালোলাগার এক বিশাল প্রাপ্তি। পর্দায় এ নায়ক যেমন উজ্জ্বল তেমনই তার ব্যক্তিজীবনের চলাচলেও ছিল নানান রঙের মিশেল। সেই অজানা জীবনের গল্প তার বয়ান থেকে অনুলিখন করেছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক-সাহিত্যিক গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ যা পরবর্তী সময়ে ‘আমার আমি’ নামে বই আকারে প্রকাশ হয়। সে বই থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে উত্তম কুমারের আত্মজীবনী-


কথার খেলাপ কখনওই করেন না গণেশদা। আগেই বলেছি, অত্যন্ত সিরিয়াস টাইপের মানুষ তিনি। আমার স্টুডিওতে যাবার আগেই ভোলাবাবুকে বলে বোধ করি সব ব্যবস্থাই পাকা করে রেখেছিলেন তিনি। আমি স্টুডিওতে ঢুকতেই গণেশদার সঙ্গে দেখা হলো।
তিনি আমাকে নিয়ে ফ্লোরে ঢুকলেন। এ যেন আমার অজানাকে জানার, অচেনাকে চেনার এক নতুন অভিযান শুরু হয়ে গেল। এ যেন আমার নতুন তীর্থদর্শন। এই আমার প্রথম ফ্লোরে ঢোকার দিন। আমার সারা মনে নতুন আনন্দের জোয়ার বইছে।
গণেশদার সঙ্গে নির্ভয়ে ফ্লোরে গেলাম। একটা হলঘরের মধ্যে একটা সম্পূর্ণ চকচকে বাড়ি। সেদিন এসব ছিল আমার চোখে বিস্ময়। বাড়িটা আর তাকে ঘিরে অনেকগুলো মানুষের কর্মচঞ্চলতা আমাকে অভিভূত করল। এ বাড়িটা একটা বিয়েবাড়ি তা বোঝা গেল। বিয়েবাড়ির সেট। আমি সাগ্রহে সব দেখছিলাম। ওদিকে গণেশদা ঘুরছেন-ফিরছেন আর আমাকে অভয় দিয়ে চলেছেন। এভাবে অনেকক্ষণ কাটল।
এমন সময় সেই ছবির ডিরেক্টর আমার কাছে এলেন। গণেশদা পরিচয় করিয়ে দিলেন আমার সঙ্গে। তিনি আমার আপাদমস্তক একবার ভালো করে দেখলেন। তারপর গণেশদার উদ্দেশ্যে বললেন, চলবে বলেই তো মনে হচ্ছে।
আমার বুকের মধ্যে তখন এক অজানা অনুভূতির কাঁপুনি শুরু হয়ে গিয়েছে। একটা দুর্বলতা আমাকে যেন ভর করেছে। পরিচালক মশাই কণ্ঠস্বর উঁচু করে কাকে যেন বললেন, একে নিয়ে যাও মেকআপ রুমে।
আমার অবস্থা তখন হাঁড়িকাঠের বলির পাঁঠার মতো। আমি একবার গণেশদার দিকে আর একবার পরিচালক মশাইয়ের দিকে তাকালাম। নিতান্ত অসহায়ভাবে আমার তাকানো। তারপর পরিচালকের নির্দেশমতো চলে গেলাম মেকআপ রুমে।
সব মনে আছে আমার। স্পষ্ট মনে পড়ছে মেকআপ রুমে নিয়ে গিয়ে বর সাজিয়ে দেওয়া হলো আমাকে। নতুন বর। আমি সাজা বর হয়ে আবার ফিরে এলাম ফ্লোরে। পরিচালক মশাই আমাকে দৃশ্যটা বুঝিয়ে দিতে এগিয়ে এলেন। বেশ গম্ভীর স্বরে বললেন, তুমি বিয়ে করতে এসেছ। তোমাকে মেরে ভাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ভালো করে বুঝে নাও, কেমন?
মনোযোগ সহকারে, গভীর মনোনিবেশে আমি বুঝে নিলাম। বুঝলাম আমাকে মেরে ভাগিয়ে দেওয়া হবে। শুনে ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। বললাম, ওরা আমাকে খুব জোরে মারবে না তো?
কথা শুনে সকলে সমস্বরে হেসে উঠলেন। আমি হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম। পরিচালক মশাই হাসতে হাসতেই বললেন, না, না, এটা বাস্তব নয়, একে বলে সিনেমার মার।
আমি যথারীতি শুটিং স্পটে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমাকে ঘিরে আলো ঝলমল করে উঠল। ক্যামেরা প্রস্তুত হলো। আমি সেই দৃশ্যে পরিচালকের নির্দেশমতোই কাজ করলাম। সেই দিনই আমার অশৈশবকালের স্বপ্ন যেন বাস্তবের মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। সেই আমার প্রথম সিনেমায় অভিনয় করা।
কাজটা একদিনেই শেষ হয়ে গেল না। পরপর পাঁচদিন আমাকে শুটিংয়ে আসতে হলো। আর এই কয়টা দিন আমি আমার মাস মাইনের অফিসটা নির্দ্বিধায় কামাই করে ফেললাম।
মনে আছে দৈনিক পাঁচ সিকি পারিশ্রমিক নিয়ে আমি সিনেমার অভিনেতা বনে গেলাম। একস্ট্রার মর্যাদাসম্পন্ন একজন অভিনেতা। সেদিন সেই ছিল আমার গর্ব। আজও তাই যারা ছবির পর্দায় নামমাত্র অংশগ্রহণ করেন তাদের আমি আমার অন্তর দিয়ে ভালোবাসি। আমি যেন ওদের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাই। আমি যে সিনেমায় নেমেছি সেই কথা জানলাম একমাত্র আমি আর গণেশদা এবং সেই ছবির সঙ্গে জড়িত কলাকুশলীরা।
দুর্ভাগ্য কি সৌভাগ্য আমার- তা জানি না, সেই হিন্দি ‘মায়াডোর’ ছবি মুক্তি পায়নি আজও। অথচ সে ছবিতে অভিনয় করার পর থেকে আমি প্রতিদিনই একরাশ আশা নিয়ে প্রতীক্ষা করেছি রুপোলি পর্দায় নিজেকে দেখব বলে। একদিকে প্রতীক্ষা করে চলেছি মায়াডোরের মুক্তিলগ্নের জন্য অন্যদিকে আবার আগের আমি বনে গেছি।
এই ছবিতে অংশ নেওয়ার বা সুযোগ পাওয়ার পর থেকে আমার নেশা যেন আরও বেড়ে গেল। মাথার ভেতরে শুধু ওই একই চিন্তা। আমি যেন সিনেমা-অভিনেতা হবার অত্যুগ্র আকাক্সক্ষায় মরিয়া হয়ে গেলাম। এ যেন নিভে যাবার আগে দপ করে আবার জ্বলে ওঠা। এ যেন হারিয়ে যাবার আগে নিজেকে শেষবারের মতো একবার দেখে নেওয়া।
সিনেমাজগতে আর আমার কাজ নেই। কাজ আছে শুধু পোর্ট কমিশনার্সের অফিসে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status