বই থেকে নেয়া
উত্তম কুমারের অজানা কথা (১৭)
‘বড়মামা যেন আমাকে আর এক নতুন ভাবনার আবর্তে ফেলে দিলেন’
৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, শুক্রবার, ১২:৪৪ অপরাহ্ন
বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি মহানায়ক উত্তম কুমার অনন্য অভিনয় জাদুতে মুগ্ধতা বিলিয়েছেন দুর্নিবার। তার অভিনীত ছবি মানেই ভালোলাগার এক বিশাল প্রাপ্তি। পর্দায় এ নায়ক যেমন উজ্জ্বল তেমনই তার ব্যক্তিজীবনের চলাচলেও ছিল নানান রঙের মিশেল। সেই অজানা জীবনের গল্প তার বয়ান থেকে অনুলিখন করেছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক-সাহিত্যিক গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ যা পরবর্তী সময়ে ‘আমার আমি’ নামে বই আকারে প্রকাশ হয়। সে বই থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে উত্তম কুমারের আত্মজীবনী-
এ সেই আমার সুহৃদসমাজ নয়, এ সেই আমার যাত্রা শেখার প্রথম আঙিনা নয়, এ আমাদের নিজেদের গড়া শখের থিয়েটার ক্লাব। আমাদের লুনার ক্লাব।
ইতিমধ্যে আমি আমাদের গড়া এই লুনার ক্লাবের পক্ষ থেকে অনেক অভিনয় করেছিলাম।
শৌখিন অভিনেতা হিসেবে তখন ভবানীপুর এলাকায় আমার নামডাকও হয়েছিল। দু-চারজন লোক আমার সঙ্গে কথা বলতেন ডেকে। কথা বলতেন আমার থিয়েটার প্রসঙ্গে। ছোটরা আঙুল দিয়ে দেখাত। আমি তখন কর্ণার্জুনের কৃষ্ণ, সাজাহানের দিলদার, দুই পুরুষের সুশোভন চরিত্রে অভিনয় করে ওদের কাছে রীতিমতো পরিচিত হয়ে পড়েছি।
তারা যখন রীতিমতো কৌতূহলী হয়ে আমাকে দেখত, তখন যেন গর্বে আমার বুক ফুলে উঠত। তখনই আমার মনে পড়ত আমার রুপোলি পর্দার অভিনেতাদের পাড়ার ওদের কাছে আমি খ্যাতিমান, আমার কাছে তেমনি তখনকার সিনেমার অভিনেতারা শ্রদ্ধার পাত্র। মনে মনে ভাবতাম কবে যে আমি ওদের মতো সিনেমার পর্দায় অভিনয় করব! ভাবনা আমার জটিল থেকে জটিলতর হতে লাগল।
আমার বড় মামার মতো মানুষ আমি কখনও দেখিনি। সাদাসিধে সহজ একটি মানুষ। খাঁটি একজন সন্ন্যাসী যেন। একরাশ অশান্তির পোকা যখন আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে, ঠিক তখনই মনে হতো যাই বড়মামার কাছে। বড়মামার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল। বেশি কথা বলতেন না। দুড়–ম করে কারও সম্বন্ধে কোনো ভবিষ্যদ্বাণী যখন করে বসতেন তা অক্ষরে অক্ষরে মিলে যেত। মাঝে মাঝে ভাবতাম বড়মামার কাছে গিয়ে হাতটা দেখাই। কিন্তু আমাকে আর যেতে হলো না। একদিন সকালে ভবানীপুরের বাড়ির ভিতরকার এক ফালি আঙিনায় ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ফুলের গাছ পুঁতছিলাম। আমার মনের ভেতরে নানা কথা ঘুরপাক খাচ্ছিল। তখন আমি চাকরি করছি। সেই চাকরি-জীবনের কথাও ভাবছিলাম। এমন সময় আমাদের বাড়িতে এলেন বড়মামা।
আমার বড়মামার নাম ধীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।
আপন মনে কাজ করছি, এমন সময় আমার পেছনে দাঁড়িয়ে বড়মামা বললেন, কী ভাবছিস রে?
মামার কণ্ঠস্বরে চমকে উঠলাম। পিছনে ফিরে বড়মামার দিকে তাকিয়ে হাসলাম, ম্লান হাসি।
কী জানি কেন কী ভেবে বড়মামা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে দুড়ুম করে বলে বসলেন- দেখ, এই মুহূর্তে তুই যা ভাবছিস আমি বলে দিলুম তুই ঠিক তাই পাবি। ও চাকরি তোর গেল বলে, অত ভাবছিস কেন?
তারপর মাকে ডেকে বললেন, তোর ছেলে চাকরি করবে ভাবছিস? করবে না, চাকরিটা ও ছেড়ে দিল বলে-
তখন বড়মামার এই কথাটাকে আমার কিন্তু অশুভ বলেই মনে হয়েছিল। চাকরি চলে যাবে, কথাটা যেন ভাবতেই পারছিলাম না। বড়মামা যেন আমাকে আর এক নতুন ভাবনার আবর্তে ফেলে দিলেন।
বড়মামা যখন যা উক্তি করতেন পরক্ষণে আর তা মনে রাখতে পারতেন না। যখন আমি প্রতিষ্ঠা পেলাম আমার এই জগতে, যখন চাকরিটা সত্যিই আমি ছাড়তে বাধ্য হলাম, তখন একবার বড়মামাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম এই প্রসঙ্গে। তখন তিনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন, তাই নাকি? এমন কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলুম নাকি আমি? তা হবে।
আমাদের বাড়ির নিচের তলায় থাকতেন গণেশদা।
অমায়িক এক ভদ্রলোক। অত্যন্ত সিরিয়াস মানুষ। তবে সিরিয়াস তিনি তার নাটুকে জীবনে। তখন বেতার বাড়ি ছিল গর্স্টিন প্লেসে। সেই বেতারবাড়ির নাটকের নিয়মিত অভিনেতা ছিলেন গণেশদা। গণেশ ব্যানার্জি। পুরোদস্তুর একজন নাটুকে লোক। পাড়াতে আমাদের যে শৌখিন দল ছিল শুধু সেখানে নয়, পাড়ায় অন্যরাও যদি নাটক করতেন তখনই গণেশদাকে ডাকা হতো। মাঝে মধ্যে গণেশদা আমাদের সঙ্গেও অভিনয় করতেন। যেদিন রিহার্সাল থাকত না সেদিন গণেশদা আমাদের ক্লাবে গিয়ে জাঁকিয়ে বসতেন। খোশমেজাজে গল্প করার স্বভাব ছিল তার। তখনকার দিনের বড় বড় অভিনেতা অভিনেত্রীদের সম্বন্ধে গল্প করতেন। আমিও গণেশদার পাশে বসে সেই সব গল্প শুনতাম, হজম করতাম।
সেই সময়ে মাঝে মাঝেই গণেশদার কাছে আসতেন ভোলাবাবু। ভোলা আঢ্য। এই নামটা তখন আমি প্রায়ই শুনতাম। প্রযোজক ভোলাবাবু গণেশদার বন্ধু হিসেবেই আসতেন। যেদিন ভোলাবাবুর সঙ্গে আলাপ সেদিন থেকে তাঁকে যেন আমি একজন বিশেষ মানুষ হিসেবে ধরেই নিয়েছিলুম। শুনলাম, ‘মায়াডোর’ নামে একটি হিন্দি ছবি তৈরি করবেন ভোলাবাবু। কথাটা কানে যেতেই মনের আশাকে ব্যক্ত করার জন্য আমি শুধু অস্থির হয়ে পড়েছিলাম।
অথচ কথাটা কিছুতেই গণেশদাকে খুলে বলতে পারছিলাম না।
এ সেই আমার সুহৃদসমাজ নয়, এ সেই আমার যাত্রা শেখার প্রথম আঙিনা নয়, এ আমাদের নিজেদের গড়া শখের থিয়েটার ক্লাব। আমাদের লুনার ক্লাব।
ইতিমধ্যে আমি আমাদের গড়া এই লুনার ক্লাবের পক্ষ থেকে অনেক অভিনয় করেছিলাম।
শৌখিন অভিনেতা হিসেবে তখন ভবানীপুর এলাকায় আমার নামডাকও হয়েছিল। দু-চারজন লোক আমার সঙ্গে কথা বলতেন ডেকে। কথা বলতেন আমার থিয়েটার প্রসঙ্গে। ছোটরা আঙুল দিয়ে দেখাত। আমি তখন কর্ণার্জুনের কৃষ্ণ, সাজাহানের দিলদার, দুই পুরুষের সুশোভন চরিত্রে অভিনয় করে ওদের কাছে রীতিমতো পরিচিত হয়ে পড়েছি।
তারা যখন রীতিমতো কৌতূহলী হয়ে আমাকে দেখত, তখন যেন গর্বে আমার বুক ফুলে উঠত। তখনই আমার মনে পড়ত আমার রুপোলি পর্দার অভিনেতাদের পাড়ার ওদের কাছে আমি খ্যাতিমান, আমার কাছে তেমনি তখনকার সিনেমার অভিনেতারা শ্রদ্ধার পাত্র। মনে মনে ভাবতাম কবে যে আমি ওদের মতো সিনেমার পর্দায় অভিনয় করব! ভাবনা আমার জটিল থেকে জটিলতর হতে লাগল।
আমার বড় মামার মতো মানুষ আমি কখনও দেখিনি। সাদাসিধে সহজ একটি মানুষ। খাঁটি একজন সন্ন্যাসী যেন। একরাশ অশান্তির পোকা যখন আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে, ঠিক তখনই মনে হতো যাই বড়মামার কাছে। বড়মামার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল। বেশি কথা বলতেন না। দুড়–ম করে কারও সম্বন্ধে কোনো ভবিষ্যদ্বাণী যখন করে বসতেন তা অক্ষরে অক্ষরে মিলে যেত। মাঝে মাঝে ভাবতাম বড়মামার কাছে গিয়ে হাতটা দেখাই। কিন্তু আমাকে আর যেতে হলো না। একদিন সকালে ভবানীপুরের বাড়ির ভিতরকার এক ফালি আঙিনায় ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ফুলের গাছ পুঁতছিলাম। আমার মনের ভেতরে নানা কথা ঘুরপাক খাচ্ছিল। তখন আমি চাকরি করছি। সেই চাকরি-জীবনের কথাও ভাবছিলাম। এমন সময় আমাদের বাড়িতে এলেন বড়মামা।
আমার বড়মামার নাম ধীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।
আপন মনে কাজ করছি, এমন সময় আমার পেছনে দাঁড়িয়ে বড়মামা বললেন, কী ভাবছিস রে?
মামার কণ্ঠস্বরে চমকে উঠলাম। পিছনে ফিরে বড়মামার দিকে তাকিয়ে হাসলাম, ম্লান হাসি।
কী জানি কেন কী ভেবে বড়মামা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে দুড়ুম করে বলে বসলেন- দেখ, এই মুহূর্তে তুই যা ভাবছিস আমি বলে দিলুম তুই ঠিক তাই পাবি। ও চাকরি তোর গেল বলে, অত ভাবছিস কেন?
তারপর মাকে ডেকে বললেন, তোর ছেলে চাকরি করবে ভাবছিস? করবে না, চাকরিটা ও ছেড়ে দিল বলে-
তখন বড়মামার এই কথাটাকে আমার কিন্তু অশুভ বলেই মনে হয়েছিল। চাকরি চলে যাবে, কথাটা যেন ভাবতেই পারছিলাম না। বড়মামা যেন আমাকে আর এক নতুন ভাবনার আবর্তে ফেলে দিলেন।
বড়মামা যখন যা উক্তি করতেন পরক্ষণে আর তা মনে রাখতে পারতেন না। যখন আমি প্রতিষ্ঠা পেলাম আমার এই জগতে, যখন চাকরিটা সত্যিই আমি ছাড়তে বাধ্য হলাম, তখন একবার বড়মামাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম এই প্রসঙ্গে। তখন তিনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন, তাই নাকি? এমন কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলুম নাকি আমি? তা হবে।
আমাদের বাড়ির নিচের তলায় থাকতেন গণেশদা।
অমায়িক এক ভদ্রলোক। অত্যন্ত সিরিয়াস মানুষ। তবে সিরিয়াস তিনি তার নাটুকে জীবনে। তখন বেতার বাড়ি ছিল গর্স্টিন প্লেসে। সেই বেতারবাড়ির নাটকের নিয়মিত অভিনেতা ছিলেন গণেশদা। গণেশ ব্যানার্জি। পুরোদস্তুর একজন নাটুকে লোক। পাড়াতে আমাদের যে শৌখিন দল ছিল শুধু সেখানে নয়, পাড়ায় অন্যরাও যদি নাটক করতেন তখনই গণেশদাকে ডাকা হতো। মাঝে মধ্যে গণেশদা আমাদের সঙ্গেও অভিনয় করতেন। যেদিন রিহার্সাল থাকত না সেদিন গণেশদা আমাদের ক্লাবে গিয়ে জাঁকিয়ে বসতেন। খোশমেজাজে গল্প করার স্বভাব ছিল তার। তখনকার দিনের বড় বড় অভিনেতা অভিনেত্রীদের সম্বন্ধে গল্প করতেন। আমিও গণেশদার পাশে বসে সেই সব গল্প শুনতাম, হজম করতাম।
সেই সময়ে মাঝে মাঝেই গণেশদার কাছে আসতেন ভোলাবাবু। ভোলা আঢ্য। এই নামটা তখন আমি প্রায়ই শুনতাম। প্রযোজক ভোলাবাবু গণেশদার বন্ধু হিসেবেই আসতেন। যেদিন ভোলাবাবুর সঙ্গে আলাপ সেদিন থেকে তাঁকে যেন আমি একজন বিশেষ মানুষ হিসেবে ধরেই নিয়েছিলুম। শুনলাম, ‘মায়াডোর’ নামে একটি হিন্দি ছবি তৈরি করবেন ভোলাবাবু। কথাটা কানে যেতেই মনের আশাকে ব্যক্ত করার জন্য আমি শুধু অস্থির হয়ে পড়েছিলাম।
অথচ কথাটা কিছুতেই গণেশদাকে খুলে বলতে পারছিলাম না।