ঢাকা, ১৮ মে ২০২৪, শনিবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিঃ

দেশ বিদেশ

বছরে ৪ বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা সরকারের

অসাধু ব্যবসায়ীদের সুরক্ষায় বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম বাড়ানো হচ্ছে দাবি ক্যাব’র

স্টাফ রিপোর্টার
৪ মে ২০২৪, শনিবার

ভর্তুকির চাপ সামলাতে বছরে চারবার বিদ্যুতের মূল্য সমন্বয় করবে সরকার। আগামী তিন বছর এই প্রক্রিয়ায় বিদ্যুৎ খাতে মোট ভর্তুকি কমিয়ে আনা হবে বলে আইএমএফ’র প্রতিনিধিদলকে জানিয়েছে সরকার। এদিকে, অসাধু ব্যবসায়ীদের ব্যবসায়িক সুরক্ষার জন্য দেশে বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম বাড়ানো হচ্ছে বলে দাবি করেছে কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। তাই ভোক্তাদের অধিকার সুরক্ষায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ভর্তুকি কমানোর শর্তের অজুহাতে বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম না বাড়িয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধের মাধ্যমে ঘাটতি পূরণের আহ্বান জানিয়েছে সংগঠনটি।  গত বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে আইএমএফের প্রতিনিধিদল বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে বৈঠক করে। সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধিদলকে জানিয়েছে, ভর্তুকির চাপ সামলাতে বছরে চারবার বিদ্যুতের মূল্য সমন্বয় করবে সরকার। আগামী তিন বছর এই প্রক্রিয়ায় বিদ্যুৎ খাতে মোট ভর্তুকি কমিয়ে আনা হবে। ভর্তুকি কমাতে বিদ্যুতের দাম সমন্বয়ের বিষয়টি বৈঠক সূত্রে জানা গেছে। বৈঠকে পেট্রোবাংলা ও বিপিসি প্রায় একইভাবে আইএমএফকে জানিয়েছে, গ্যাস ও জ্বালানি তেলে নতুন করে ভর্তুকির চাপ নেই। তেলের দাম নিয়ে স্বয়ংক্রিয় যে পদ্ধতি (আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়লে দেশে বাড়বে, কমলে কমবে) চালু করার কথা আইএমএফ বলেছিল, তা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন
প্রতি মাসে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা হচ্ছে। এতে জ্বালানি তেলে আর কখনো ভর্তুকি দিতে হবে না। প্রথম দুই দফায় দাম কিছুটা কমানো হলেও শেষ দফায় দাম বেড়েছে।

 তিন মাস ধরে এ চর্চা করা হচ্ছে। বৈঠকে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে যে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয়, তার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে আইএমএফ। গত বছর ৪১ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা অলস বসে ছিল। তার মানে অলস বসিয়ে রেখে কেন্দ্র ভাড়া দেয়া হচ্ছে। বিদ্যুৎ বিভাগ আইএমএফকে জানিয়েছে, চুক্তি থাকায় ক্যাপাসিটি চার্জ দিতেই হবে। তবে সরকার ইতিমধ্যে ‘বিদ্যুৎ নেই, বিলও নেই’ পদ্ধতি চালু করেছে। নতুন করে চুক্তি নবায়নের ক্ষেত্রে ক্যাপাসিটি চার্জ বাদ দেয়ার সুযোগ আছে। দেশে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয়টি বৈঠকে এসেছে। এক্ষেত্রে আইএমএফের প্রশ্ন ছিল, এরপর বিদ্যুতে ভর্তুকি আরও বাড়বে কিনা। বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ভর্তুকি বাড়বে না। কারণ, এ বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ প্রচলিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন খরচের তুলনায় অনেক কম হবে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গত ফেব্রুয়ারিতে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করা হয়। ঘাটতি মেটাতে দাম সমন্বয় করা হচ্ছে। আগামী তিন বছর ধরে ধাপে ধাপে দাম সমন্বয় করা হবে। এর অংশ হিসেবে গত মার্চ মাসে বিদ্যুতের দাম সরকার একবার বাড়ায়। পিডিবি সূত্রে জানা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদ্যুৎ বিক্রি করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) লোকসান হয়েছে ৪৩ হাজার ৫৩৯ কোটি টাকা। 

সরকারকে ওই অর্থবছরে ৩৯ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা ভর্তুকি বরাদ্দ রাখতে হয়। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের পাইকারি দাম গড়ে ৭ টাকা ৪ পয়সা। তবে আইএমএফের পরামর্শ মেনে ভর্তুকি প্রত্যাহার করা হলে এ দর ১২ টাকার ওপরে নিয়ে যেতে হবে। সেক্ষেত্রে ভোক্তাপর্যায়ে গড়ে বিদ্যুতের দাম হবে প্রায় ১৫ টাকা, যা এখন ৮ টাকা ৯৫ পয়সা। এর আগে গত বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে তিন দফায় বাড়ানো হয়েছিল বিদ্যুতের দাম। গত দেড় দশকে পাইকারি পর্যায়ে ১২ বার ও খুচরায় ১৪ দফা বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। এ বছরও ঢাকার বাইরে দিনে দেড় থেকে দুই হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং করা হয়েছে। এতে দেশের কোনো কোনো গ্রামাঞ্চলে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎ লোডশেডিংয়ে মানুষ দুর্ভোগে পড়েন। এদিকে, গত ২রা মে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা জাতীয় সংগঠন ক্যাব’র এক সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে সংগঠনটির জ্বালানি উপদেষ্টা ড. এম শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ আইন ২০১০ এর আওতায় প্রতিযোগিতাহীন ব্যক্তিখাত বিনিয়োগে খাতটির উন্নয়ন অব্যাহত আছে। তাতে বিনিয়োগকারীরা খেয়াল-খুশিমতো বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ ব্যয় বাড়িয়ে লুণ্ঠনমূলক মুনাফার সুযোগ নিচ্ছে। ফলে আর্থিক ঘাটতি দ্রুত বাড়ছে। আর তা সমন্বয়ে মূল্য ও ভর্তুকি উভয় বাড়ছে। ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, সরকার এখন ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণের জন্য দিশাহারা হয়ে আইএমএফের পেছনে দৌড়াচ্ছে। সেখানে জনগণের স্বার্থ ও কল্যাণ তথা জ্বালানি নিরাপত্তা সুরক্ষা নিশ্চিত করা এখন আর সরকারের জন্য ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাই ভোক্তারা চরম উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে। 

এ অবস্থায় জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা হারানোর ভয়ে ভীত হয়ে আমরা সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি ‘অসাধু বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবসায় লাগাম দিন, মূল্য বৃদ্ধি থেকে সরে আসুন- মানুষকে অভয় দিন’। ক্যাব’র অনুষ্ঠানে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এজাজ হোসাইন বলেন, সরকার যে দাম বাড়াবে (বিদ্যুৎ-জ্বালানির), সেটা আমি দেবো। কিন্তু তার মধ্যে যে চুরি ও অপচয় রয়েছে, তার দায় কেন আমি নেবো? জ্বালানি নেই, তবুও পাওয়ার প্লান্ট করা হচ্ছে। আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক কেন অনিয়মের খোঁজ নেয় না। বাংলাদেশে এখনো ৩০ শতাংশ ফার্নেস অয়েল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। কিন্তু বিশ্বের কোথাও ৫ শতাংশের বেশি নেই। এসব বিষয়ে দাতা সংস্থাগুলো কেন পদক্ষেপ নিচ্ছে না? তিনি বলেন, ২৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে লাভ কি, যদি উৎপাদন না করা যায়। আমি মনে করি, দেশে ১৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র থাকলেই এনাফ (সম্ভব)। কারণ এর বেশি তো আর দেশে উৎপাদন হচ্ছে না। মাঝে মধ্যে ১৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের তথ্য পাওয়া যায়।

 বাকি সময়ে ১২-১৩ হাজার মেগাওয়াটই উৎপাদন হয়। তাহলে বাড়তি অপচয়ের বিষয়ে আইএমএফ কেন দেখছে না? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি একটি স্ট্যাটেটিক পণ্য বা সেবা। তাই নোটিশের মাধ্যমে এই মূল্যবৃদ্ধি গ্রহণ যোগ্য নয়। এটা বিইআরসির গণশুনানির মাধ্যমে হবে, আর সেটাই কাম্য। কিন্তু নির্বাহী আদেশে বিইআরসির শক্তিকে খর্ব করে রাখা হয়েছে। এখন বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম বাড়ছে নির্বাহী আদেশে। এর মাধ্যমে অধিকার হারাচ্ছে জনগণ। এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক সামসুল হুদা বলেন, বিশ্বের কোন দেশ আইএমএফের শর্তে ঋণ নিয়ে উন্নতি করেছে, এমন নজির কোথাও নেই। আর এ বিষয়ে সরকারকে নজর রাখা দরকার। তাই তাদের শর্তের বেড়াজালে-দেশকে বিপদে ফেলবেন না। কারণ তাদের শর্ত জনগণের স্বার্থে নয়। ক্যাব’র সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, আইএমএফ বলেছে মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে ভর্তুকি কমানোর। কিন্তু এটা যুক্তিসঙ্গত নয়। এটা সুবিচারও নয়। তাই আমরা আইএমএফকে বলবো- (দাম বাড়ানোর শর্ত না দিয়ে) কোথায় অসঙ্গতি আছে, সেটা খুঁজে বের করতে। বিদ্যুৎ-জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি না করে ৩ বছরের মধ্যে ভর্তুকি শূন্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে ক্যাব’র পক্ষ থেকে ১৩ দফা দাবি তুলে ধরা হয়। এরমধ্যে রয়েছে- বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত উন্নয়নে প্রতিযোগিতাবিহীন যেকোনো ধরনের বিনিয়োগ আইন দ্বারা নিষিদ্ধ হতে হবে। জ্বালানি অধিকার সংরক্ষণ ও জ্বালানি সুবিচারের পরিপন্থি হওয়ায় (ক) দ্রুত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ (বিশেষ বিধান) আইন ২০১০ রদ হতে হবে, এবং (খ) বাংলাদেশ রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) আইন ২০০৩ সংশোধনক্রমে সংযোজিত ধারা ৩৪ক রহিত হতে হবে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যহার নির্ধারণের একক এখতিয়ার বিইআরসি’কে ফিরিয়ে দিতে হবে ইত্যাদি।  প্রসঙ্গত, আইএমএফ ২০২৩ সালের ৩০শে জানুয়ারি বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচি অনুমোদন করে। এ সময় অন্য অনেক শর্তের মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি কমিয়ে আনা, জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ে আন্তর্জাতিক রীতিনীতি অনুসরণ করা হচ্ছে অন্যতম।  

দেশ বিদেশ থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

দেশ বিদেশ সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status